২৫-নভেম্বর-২০২৪
২৫-নভেম্বর-২০২৪
Logo
জাতীয়

উচ্চশিক্ষিত বেকার আর নয়

মিজানুর রহমান:
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-১৬ ১৫:১৯:৫৯
...

দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে কর্মদক্ষতার সম্পর্কহীনতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যার উপস্থিতি প্রকট। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীদের চাকরির বাজারে অনেকাংশে চাহিদা নেই। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ শতাংশ স্নাতক বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়টি এ অবস্থা থেকে বের হতে চায়।

শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অনার্স ভর্তিতে যোগ্য শিক্ষার্থী বাছাই, ১২টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা (পিজিডি) কোর্স এবং ১৯টি শর্ট কোর্স চালু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ‘উচ্চশিক্ষিত বেকার’ না বানিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে এসব উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। আর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘উচ্চশিক্ষিত বেকার বানিয়ে লাভ নেই। যুগের চাহিদা ও আমাদের দেশের চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তটা যুগোপযোগী হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন সবাইকে অনার্স পড়াবে? আমাদের লক্ষ্য শিক্ষিত বেকার তৈরি করা নয়, শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। দক্ষ জনশক্তি করতে গেলে শুধু অনার্স-মাস্টার্স করিয়ে হয় না। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই যারা বিষয়ভিত্তিক চাকরিতে যাবেন বা শিক্ষকতা করবেন তারা বিশেষ কোনও বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। বাকি জনগোষ্ঠী দক্ষ হবে। এছাড়া যারা একান্তই অনার্স করতে আগ্রহী তাদের অনার্স করার ব্যবস্থা দেশে ও বিদেশে রয়েছে।’

রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, ‘বিশেষ করে ইংরেজি ও আইসিটিতে আমরা যদি দক্ষতা বাড়াতে পারি তাহলেও লাখ লাখ ডলার যে বাইরে চলে যায় তা আমরা ঠেকাতে পারবো। এছাড়া এই উদ্যোগ জনশক্তি রফতানিতে ভূমিকা রাখবে। জনশক্তির অপচয় রোধ করা খুব জরুরি। সে কারণেই এই উদ্যোগটি ভালো।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের সাধারণ শিক্ষা তো থাকবেই। কিন্তু বেশি নজর দিতে হবে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেদিকে যাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষা যতটা গুরুত্ব এতদিন পেয়েছে, তত বেশি গুরুত্ব পায়নি বৃত্তিমূলক শিক্ষা। আমরা বিজ্ঞানী তৈরি করতে পারিনি। পেশাভিত্তিক দক্ষ জনশক্তিও তৈরি করতে পারিনি। আমরা কিছু আমলা তৈরি করেছি। তবে বেশি ভালো আমলাও তৈরি করতে পারিনি।’

অধ্যাপক আবদুল মান্নান আরও বলেন, ‘আমরা যেভাবে ডিগ্রির পেছনে ঘুরি, পৃথিবীর কোনও দেশ এভাবে ঘোরে না। পাশের দেশ ভারতও না। বাংলাদেশে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোয়ার সুপারভাইজার আনতে হয় বাইরে থেকে, ওয়েল্ডার আনতে হয় বাইরে থেকে। আর সে কারণেই বেশি দরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষা। কত লোককে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে, তার কোনও পরিকল্পনা নেই। এটা করা জরুরি।’

ইউজিসি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগটি ভালো। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও বিষয়টি নিয়ে হয়তো ভাববে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে যাতে অতিরিক্ত উচ্চশিক্ষার্থী ভর্তি না করে। যেখানে যতজনকে অনার্স পড়ানোর সুযোগ সুবিধা আছে সেখানে ততটাই পড়াবে। আর সেখানে মাস্টার্স করানোর যতটা সুযোগ-সুবিধা আছে সেখানে ততটুকুই ভর্তি করাবে। যেখানে অনার্স করানোর সুবিধা আছে অথচ মাস্টার্স করানোর সুযোগ নেই, সেখানে যেন ভর্তি না করায়।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে—উচ্চশিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম জিপিএ থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, অনার্সে ল্যাংগুয়েজ, আইসিটি ও একটি সফট স্কিল সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জিপিএ আরও বাড়িয়ে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় দেশের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। বেকার উচ্চশিক্ষিত তৈরি না করে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষায় নিয়ে যাওয়া উচিত। আর সে কারণেই এসব পদক্ষেপ নিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, “আমাদের আগের রেকর্ড অনুযায়ী এমনিতেই কম জিপিএ নিয়ে চান্স পায় না। যেখানে আমরা মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করবো, সেখানে আমরা চাইবো কোয়ালিটি স্টুডেন্ট আসুক। যারা রেজাল্ট ভালো করছে না, তারা নানান রকম ট্রেড আছে, সেখানে ভর্তি হবে। সবাইকে কেন অনার্স পড়তে হবে? আমরা যদি কোয়ালিটির কথা বলি—তাহলে তুলনামূলক যারা ভালো ছাত্র তারা অনার্সে পড়তে যাবে। যারা রেজাল্ট ভালো করতে পারছে না তারা মেধাবী নয় তা না। তারাও অনেক ট্রেডে ভালো করতে পারবে। সবাই মিলে উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকে লাভ নেই। যেকোনও বিষয়ে যেনতেনভাবে অনার্স-মাস্টার্স করলে লাইফে কিছু করার মতো অবস্থা তৈরি হবে না। আমরা তো ‘শিক্ষিত বেকার’ তৈরি করতে পারি না। আমরা শিক্ষার্থী ভর্তিতে জিপিএ যা নির্ধারণ করেছি সেটা ঠিক আছে।”

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ভর্তিতে মানবিক বিষয়ে জিপিএ (গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ) এসএসসি সমমান ও এইচএসসি সমমান পরীক্ষায় ৬.৫ নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর বাণিজ্য ও বিজ্ঞান পড়তে হলে জিপিএ-৭ থাকতে হবে। যারা এই পয়েন্টের নিচে তাদের জন্য রয়েছে ডিগ্রি কোর্স ও শর্ট কোর্স এবং ডিগ্রি সম্পন্ন হওয়ার পর রয়েছে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা (পিজিডি)। এতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কেউ বেকার থাকবে না। আর কেউ অনার্স না পড়লেও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে পারবে চাকরির বাজারে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে জানানো হয়, ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের আগে অনার্সে ভর্তিতে জিপিএ কম রাখা হলেও ভর্তি নেওয়ার ক্ষেত্রে জিপিএ যাদের বেশি তাদেরই নেওয়া হয়েছে। আর সে কারণে বিগত বছরগুলোতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ক্যাডার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্যাডারে সর্বোচ্চ ভালো ফলাফলের রেকর্ড করতে পেরেছে। ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে জিপিএ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, জীবনে প্রথমবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে (মেধাক্রম ১৫৮) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন আবু আবদুল্লাহ। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ২০১৯ সালে স্নাতক পাস করেন। ফরিদপুরের সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স করে ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে মাস্টার্স করে ফাল্গুনী বাগচি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এই শিক্ষার্থী জাতীয় মেধা তালিকায় ১৩তম হয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেনী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী আব্দুল আজিজ জীবনের প্রথম বিসিএস (৪৩তম) চূড়ান্ত পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর আরও জানায়, অনার্স ভর্তিতে শিক্ষার্থী বাছাই এবং বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ায় অল্প দিনের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী প্রশাসন ক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। নন-ক্যাডারসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সহজে যেতে পারছেন শিক্ষার্থীরা।

DP-ASIF