২২-নভেম্বর-২০২৪
২২-নভেম্বর-২০২৪
Logo
জাতীয়

উদ্ভাবনী সিভিল সার্ভিস গড়বে স্মার্ট বাংলাদেশ

মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন ও নিলুফা ইয়াসমিন
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-০৯ ১৪:৫৫:৩৬
...

ময়মনসিংহের এক স্থানীয় সরকারের কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মালেক। কৃষকদের ফসলহানি ও ফলনের ঘাটতিতে তিনি ব্যথিত ও চিন্তিত থাকতেন। কৃষকদের সমস্যাগুলোর একটি সহজ, কম খরুচে ও টেকসই সমাধান চাইতেন তিনি। কিন্তু ঠিক কীভাবে সমাধান করবেন তা বুঝে উঠতে পারতেন না। অগত্যা প্রচলিত পদ্ধতির ওপরই তাকে নির্ভর করতে হতো। এর মধ্যে ২০১৪ সালে আব্দুল মালেক সুযোগ পান এমপ্যাথি ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার। ওই প্রশিক্ষণেই তিনি শেখেন কীভাবে প্রযুক্তির সহযোগিতায় উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করা যায়। আর তাতেই এতদিনের ভাবনাকে বাস্তব রূপদানের পথ পেয়ে যান তিনি। তৈরি করেন ‘কৃষকের জানালা’ অ্যাপ।

এ অ্যাপের মাধ্যমে কৃষিবিষয়ক যাবতীয় সমস্যার সমাধান পেয়ে থাকেন কৃষকেরা। এই অ্যাপের সহায়তায় ফসলের ছবি দেখেই কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে শস্যের রোগ-বালাই শনাক্ত করতে পারেন। এর পরের গল্প কমবেশি সবারই জানা। অ্যাসপায়ার টু ইনোভেটের (এটুআই) সহায়তায় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্যোগে অ্যাপটি দেশব্যাপী লাখ লাখ কৃষককে দিচ্ছে নানা সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান। কর্তৃপক্ষের আশায় বসে না থেকে মাঠপর্যায়ের এক কৃষি কর্মকর্তা এভাবেই অত্যন্ত কার্যকর ও আধুনিক সমাধান নিয়ে হাজির হলেন। জনগণকে দেওয়া সরকারের সেবাগুলো এমন করে সিভিল সার্ভিসের উদ্ভাবন ও কর্মদক্ষতায় আরও জনবান্ধব ও আধুনিক হয়ে উঠলে কেমন হবে, বলুন তো? নির্দ্বিধায় যে কেউ বলবে, নিঃসন্দেহে ভালো এবং সেটি দেশ ও দেশের সব মানুষের জন্য।

সে লক্ষ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগগুলো বাস্তব রূপ লাভ করতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। সরকারের গৃহীত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে কাগজবিহীন, সহজ ও নাগরিকবান্ধব সেবা নিশ্চিতকরণ, ২০৩১ সালের মধ্যে হবে শতভাগ কাগজবিহীন ও ব্যক্তি-চাহিদা অনুযায়ী (পারসোনালাইজড)। শুধু তাই নয়, ২০৪১ সালের মধ্যে এ সেবাগুলো হবে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি দ্বারা পরিচালিত। ফলে সব ধরনের সরকারি সেবা নাগরিকের মনের ভাষা বুঝে কাজ করবে। স্মার্ট সরকার পরিচালিত হবে ই-গভর্ন্যান্স পদ্ধতিতে। সরকারের সব সেবা, কার্যক্রম ও বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অবস্থা পর্যবেক্ষণে থাকবে ট্র্যাকার। এতে করে মন্ত্রণালয়গুলো তাদের অবস্থান সহজে জানতে এবং বাস্তবসম্মত নতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে পারবে।

কিন্তু ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি পরিচালিত সরকার পরিচালনায় চাই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ ও উদ্ভাবনী মানসিকতাসম্পন্ন সিভিল সার্ভিস। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বর্তমান সরকার। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা এবং পরবর্তীতে প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যার অন্তর্ভুক্তি উদ্ভাবন চর্চার পথকে আরও সুগম করে। ২০১৩ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি সব দফতরে ইনোভেশন টিম গঠনের নির্দেশনা দিলে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

এমন উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর সুফলও পেতে শুরু করে জনগণ। এটুআইয়ের টিসিবি বিষয়ক সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী উদ্ভাবনী ধারণা প্রয়োগ করে সেবা সহজীকরণ বা সেবা ডিজিটাইজেশনের কারণে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে সেবাগ্রহীতাগণের গড়ে প্রায় ৮২ শতাংশ সময়, ৭৮ শতাংশ খরচ ও ৮৫ শতাংশ ভিজিট সাশ্রয় হয়েছে।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সিভিল সার্ভিসের প্রতিটি কর্মকর্তাকে গড়ে তোলা হবে নতুন নতুন ভাবনা ও উদ্ভাবনকে মানিয়ে নেওয়ার উপযোগী করে। তাদের পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত ও কাজে থাকবে জনবান্ধব সুদূরপ্রসারী ভাবনার প্রতিফলন। সময়ের সঙ্গে সবকিছু বদলে যায়, এর সঙ্গে বদলে যায় নাগরিক চাহিদাগুলোও, বিষয়টি তাদের মননে ও মগজে থাকবে। মানে সিভিল সার্ভিসের প্রতিটি কর্মকর্তা হবেন গভপ্রেনিউর এবং ডিজিটাল নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন।

গভপ্রেনিউর কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মালেকের গল্পটি লেখার শুরুতেই বলেছি। সরকারি কর্মকর্তাদের গভপ্রেনিউর হওয়ার জন্য উৎসাহিত করার অনেক সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এটি সরকারের কার্যক্রমকে উন্নত করে। দ্বিতীয়ত, এটি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তৃতীয়ত, এটি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতেও সাহায্য করে। সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যা সরকারি কর্মকর্তাদের গভপ্রেনিউর হতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি সুযোগও তৈরি করে দেবে। উদাহরণস্বরূপ, ভূমি মন্ত্রণালয় ‘ই-নামজারি’ (মিউটেশন), ‘ডিজিটাল রেকর্ডরুম’ ও ক্যাশলেস পেমেন্টের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘হেলথ স্ট্যাক’, ‘বিসিসি হসপিটাল অটোমেশন’ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর ‘শেয়ার্ড হেলথ রেকর্ড’ পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

সরকারি সেবাগুলোকে প্রতিটি নাগরিকের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদানের লক্ষ্যে ব্যবহার করা হবে বিগ ডাটানির্ভর মেশিং লার্নিং তথা এআই-নির্ভর আগামী দিনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলো। কিন্তু শুধু প্রযুক্তি উন্নত হলে চলবে কি? না, উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর সেবা দিতে হলে সেবা প্রদানকারীরও প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা থাকতে হবে। আর তাই গভপ্রেনিউরের পাশাপাশি সিভিল সার্ভিস ২০৪১-এর লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে ডিজিটাল নেতৃত্বগুণ গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে সিভিল সার্ভিস নিজেকে আগামী দিনের উপযোগী করে গড়ে নেবে, জনগণের চাহিদা পূরণে আজকের চেয়েও হয়ে উঠবে বেশি দক্ষ।

ডিজিটাল নেতৃত্বগুণের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হচ্ছে টেকসই ই-গভর্ন্যান্স। কাগজ, কলমের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সেবা প্রদান, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি এসবই হবে টেকসই ই-গভর্ন্যান্সের লক্ষ্য। আরেকটি স্তম্ভ হচ্ছে ডাটা লিডারশিপ। তথ্যই শক্তি। কোনো সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সমাধানের নীতিমালা তৈরি সবকিছুতেই ভরসা করতে হবে ডাটার ওপর। অত্যাধুনিক ডাটা বিশ্লেষণে দক্ষ হয়ে উঠবে সিভিল সার্ভিস। এ ছাড়া আরেকটি স্তম্ভ হচ্ছে উদীয়মান ডিজিটাল প্রযুক্তি- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ইন্টারনেট অব থিংস ইত্যাদি। এসব নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনপ্রশানের প্রতিটি কর্মী নিজেকে হালনাগাদ রাখবেন।

প্রশ্ন হতে পারে- দেশব্যাপী বিস্তৃত সিভিল সার্ভিসকে কীভাবে গভপ্রেনিউর এবং ডিজিটাল নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। সিভিল সার্ভিস ২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে পাঁচটি গুণ ও দক্ষতা নিশ্চিত করা। এগুলো হচ্ছে- কার্যকর অন্তর্দৃষ্টি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্লেষণ সক্ষমতা, ডাটা ব্যবহারের সক্ষমতা, ডিজিটাল দক্ষতা এবং সহযোগিতামূলক নেটওয়ার্ক। এ কার্যক্রমকে তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে সিভিল সার্ভিস কর্মীরা নিজেদের জ্ঞানকে সুদৃঢ় করবেন, সহকর্মীদের সম্মান অর্জন করবেন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করবেন। এ প্রক্রিয়ায় নিজ উদ্যোগে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলবেন।

দ্বিতীয় ধাপে, বিশেষায়িত দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন তারা। ডিজিটাল নেতৃত্ব, ই-গভর্ন্যান্স, সরকারি সেবা কার্যক্রম, উদীয়মান প্রযুক্তির বিকাশ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তারা নিজেদের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবেন।

তৃতীয় ধাপে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কর্মকর্তাদের কোচিং স্কিলস সেশন ও ট্রেনিং ফর ট্রেইনার্সের (টিওটি) মাধ্যমে ডিজিটাল নেতৃত্ব প্রশিক্ষণের কোচ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। নবীন কোচদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মাস্টার ট্রেইনার পুল, মেন্টর পুল গঠনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের ডিজিটাল নেতৃত্ব ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কও গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়াও অনলাইন সিমুলেশন, গেমস, কেস স্টাডি, পিয়ার টিচিং ও মেন্টরশিপের মতো বহুমুখী শিক্ষণ কৌশল ব্যবহার করা হবে।

গভপ্রেনিউর ও ডিজিটাল নেতৃত্বগুণসম্পন্ন সিভিল সার্ভিস ২০৪১ বাস্তবায়নে সরকারি বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারের কোর্সগুলোকে আপডেট করার কাজ চলছে। এতে একযোগে বিপুল পরিমাণ সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের জ্ঞানার্জন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়া চলছে। এ জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছে এটুআই। এ ছাড়া রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও এ বিষয়ে সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

গভপ্রেনিউর ও ডিজিটাল নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন সিভিল সার্ভিসই হবে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম ভিত্তি। তারা জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেবেন, নিশ্চিত করবেন উন্নতমানের জীবন। সরকারের কার্যক্রমকে করবেন দক্ষ ও কার্যকর। তৈরি করবেন একটি নাগরিক-বান্ধব ও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত বাংলাদেশ।

লেখক দ্বয়: প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট, এটুআই এবং উপপরিচালক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর।