পুলিশের আলোচিত-সমালোচিত কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদ। গত কয়েক বছরে ৩১তম বিসিএস’র এই পুলিশ কর্মকর্তা একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হওয়ার পর থেকেই অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও এই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনকালে ছাত্রদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সব সময়েই তিনি পার পেয়ে গেছেন। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে থানায় নিয়ে বেধড়ক মারধরের পর রোববার তাকে রমনা জোনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
জানা যায়, হারুন-অর-রশীদের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের থানাঘাটা গ্রামের মাড়িয়ালায়। তার বাবার নাম জামাল উদ্দীন গাজী, মা শেফালী খানম। ১৯৮৮ সালের জুনে জন্মের পর প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন এলাকাতেই। এরপর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ২০০৫-০৬ সেশনে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওঠেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানিয়েছে, হারুনের পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে তিনিও কখনো ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না।
হল ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা যুগান্তরকে জানান, হলে উঠে হারুন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হননি। সরকার পরিবর্তন হলে হলটির অনেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরে হল শাখা ছাত্রলীগের এক নেতার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। পুলিশের এএসপি হয়ে গেলে তাদের মধ্যে সখ্য বাড়ে। ততদিনে ওই ছাত্রলীগ নেতাও কেন্দ্রের বড় নেতা হয়ে যান। এরপর থেকে ছাত্রলীগ নেতার বন্ধু হিসাবে বিভিন্ন মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ডিএমপির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসাবে পরিচিত রমনা জোনের এডিসি হিসাবে পদায়ন হয় তার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হল ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি বিএম মারুফ বিল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, হারুনের বাড়ি আমার বাড়ি একই এলাকায়। আমি সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সভাপতি ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদক ছিলাম। কেন্দ্রের উপসম্পাদক ছিলাম। আমি কখনোই হারুনকে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগ করতে দেখিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলটির সাবেক আরেক সহসভাপতি বলেন, হারুন জিয়া হলে ওঠেন ছাত্রদলের রাজনৈতিক রুম ২০৮-এ। এরপর ছাত্রদলের ক্যান্টনমেন্ট খ্যাত ৩১০ নম্বর কক্ষে ছিলেন। বন্ধু ছাত্রলীগ নেতার সূত্রে আরও অনেক ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেই সুবিধা নিয়ে হলে কোনো পদ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কমিটি গঠনের পর বর্ধিত কমিটিতে সহসম্পাদক পদ নেন। তবে ছাত্রলীগের আরেকটি সূত্রের দাবি, তিনি সহসম্পাদক নন পরিবেশবিষয়ক উপসম্পাদকের পদ পেয়েছিলেন। তবে ছাত্রলীগের কোনো দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এ ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে এ ঘটনার পর হারুনের বিষয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায় থেকে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে এডিসি হারুন-অর-রশীদকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
হারুনের যত বিতর্কিত কাজ : হারুন সাংবাদিকদের ওপর হামলা, শিক্ষার্থীদের মারধর, বাহিনীর কনস্টেবলকে মারধরসহ নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অনেক সময় অতি উৎসাহী হয়ে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এর আগে রমনা জোনের দায়িত্ব পালন করা কাউকে নিয়ে এত বিতর্ক হয়নি। যদিও হারুন বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অথবা নিজের কাজের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে একটি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের পিটিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি। পেটানোর আগে তার গায়ে জ্যাকেট এবং মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেন তার সহকর্মীরা। হেলমেট পরানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারমুখী হয়ে ওঠেন।
এর আগে নিজ সহকর্মীকেও চড় মেরে সমালোচিত হয়েছিলেন এডিসি হারুন। নিউ মার্কেট এলাকায় দোকান মালিক, বিক্রেতা ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের দিকে রাবারের বুলেট ছুড়তে এক কনস্টেবলকে নির্দেশ দেন তিনি। বুলেট শেষ বলায় তাকে চড় মারেন তিনি। ঘটনাটির একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন এই এডিসি।
গত বছরের ৪ মার্চ গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ মিছিলে ঢাকা ক্লাবের সামনে রমনা জোনের উপকমিশনার হারুন-অর-রশীদের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ও সাদা পোশাকের লোক বিক্ষোভকারীদের ওপর অতর্কিত লাঠিচার্জ করে। একই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে পুলিশ ছাত্রদলের ‘শান্তিপূর্ণ’ সমাবেশে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে বিচার চেয়ে শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও অন্যান্য বাম সংগঠন আয়োজিত মশাল মিছিলে লাঠিপেটা করে পুলিশ। সেখানেও হারুন ছিলেন।
গত বছরের মাঝামাঝিতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলনে পুলিশের লাঠিপেটার ছবি তুলতে গিয়ে হারুনের অসদাচরণের শিকার হন কয়েকজন সাংবাদিক।
রোববার এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে। তাকে বলা হয়, এডিসি হারুন সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ী-সহকর্মীদের গায়ে হাত তুলেছেন। এখন পর্যন্ত তাকে কোনো ধরনের বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি-গণমাধ্যমকর্মীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে এই ঘটনাটি প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে। আমরা এটা দেখে নিই। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি, অবশ্যই তিনি যতখানি অন্যায় করেছেন, ততখানি শাস্তি তিনি পাবেন।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL