পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকা ডলার হোঁচট খাচ্ছে, হাঁটছে এখন উল্টো দিকে। ফলে অতি মুনাফালোভীরা পড়েছেন বিপাকে। বেশি লাভের আশায় যারা খোলাবাজার থেকে ১২০ টাকায় ডলার কিনেছিলেন তাদের মাথায় হাত। ডলার নেমে এসেছে ১০৯ টাকায়। শক্তিশালী হতে শুরু করেছে টাকা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাজারে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের সরবরাহ বেশ বেড়েছে। সবাই বিক্রি করতে আসে; কেউ কিনতে আসে না। এতদিন যারা বেশি লাভের আশায় ডলার কিনে মজুত করেছিলেন, তারা সবাই এখন বিক্রি করতে আসছেন। সে কারণেই দুর্বল হচ্ছে ডলার, মান বাড়ছে টাকার। আগামী সপ্তাহের মধ্যে ডলারের দর ১০৫ টাকায় নেমে আসবে বলে মনে করছেন তারা।
গত বুধবার সকালে খোলাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য ১১০ টাকা নিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা; বিকেলে তা ১০৯ টাকায় নেমে আসে। আর গত মঙ্গলবার প্রতি ডলার ১১৩ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১১৩ টাকা ৩০ পয়সায় বিক্রি হয়েছিল। রোববার প্রতি ডলারের জন্য ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা নিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
আমদানি কমায় ডলারের চাহিদা কমে এসেছে। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর কমছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকগুলোও নগদ ডলারের দাম কমাতে শুরু করেছে। বেসরকারি সিটি ব্যাংক গত মঙ্গলবার প্রতি ডলারের জন্য নিয়েছিল ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। বুধবার নিয়েছে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। তবে অন্য ব্যাংকগুলো আগের দামেই নগদ ডলার বিক্রি করছে।
খোলাবাজারে গত সপ্তাহে ডলারের দর এক লাফে ১২০ টাকায় উঠেছিল। বৃহস্পতিবার তা এক টাকা কমে বিক্রি হয় ১১৯ টাকায়। এর পর থেকে টাকার বিপরীতে প্রতিদিনই কমছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোলাবাজারের এক ডলার ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ এখন প্রচুর। সবাই বিক্রি করতে আসে; কেউ কিনতে আসে না। দু-একজন আসে দাম শুনে; তবে কেনে না। সকালে ১১০ টাকায় সামান্য কিছু বিক্রি করেছি আমরা। বিকেলে ১০৯ টাকা দিয়েও ক্রেতা পাওয়া যায়নি। এতদিন যারা বেশি লাভের আশায় ডলার কিনে মজুত করেছিলেন, দাম কমতে দেখে তারা সবাই এখন বিক্রি করতে আসছে। সে কারণেই সরবরাহ বেড়েছে। দাম কমছে। যারা পাগলের মতো ডলার কিনেছিলেন তারা সবাই ধরা। সবাই এখন বিক্রি করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। সরবরাহ বেড়েছে; তাই দাম কমছে। আরো কমবে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ডলারের দর ১০৫ টাকায় নেমে আসবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক গত কয়েক দিনের মতো বুধবারও ১০৪ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে কিনতে লেগেছে ১০৪ টাকা ২৫ পয়সা। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৭ টাকায়। এসআইবিএল নিয়েছে ১০৫ টাকা।
গত সপ্তাহের মতো বুধবার ৯৫ টাকায় ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটাকে আন্তঃব্যাংক বা ইন্টারব্যাংক রেট বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই রেট গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে কার্যত অচল।
ব্যাংকগুলো এখনো এই দরের চেয়ে ৯ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। আবার প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে ১০৪-১০৫ টাকা দিয়ে। আমদানি ঋণপত্র খুলতে নিচ্ছে ১০৪-১০৫ টাকা।
বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দৌড় থামাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দেড় মাসে (১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট) প্রায় ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এরপরও বাজারে ডলারের সংকট কাটছিল না।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম আশার কথা শুনিয়ে বলেছেন, শিগগিরই ডলারের সংকট কেটে যাবে। বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ইতোমধ্যে কার্ব মার্কেটে বেশ খানিকটা কমেছে।
তিনি বলেন, আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণেই বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। সেই চাহিদা পূরণের জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলার ছাড়া হচ্ছে। আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ এটি। যখন বাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দেবে তখন ডলার বিক্রি করা হবে। আবার যখন সরবরাহ বেশি হবে তখন কেনা হবে। ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে রিজার্ভ পরিস্থিতিও সব সময় বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। ঢালাও বিক্রি করলে রিজার্ভ কমে আসবে। সেক্ষেত্রে অন্য সমস্যা হবে। সে কারণেই ভেবে-চিন্তে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি বিক্রি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাণ্ডব বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব দেশের মতো আমাদেরও আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণে রিজার্ভের ওপরও চাপ পড়েছে। তবে সুখের খবর হচ্ছে, আমদানি কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্সও বাড়ছে। শিগগিরই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এর আগে মে মাসে যখন ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়ে ছিল, তখনো সবাই অতি মুনাফার আশায় জমানো টাকা দিয়ে ডলার কিনেছিলেন। অনেকে পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে, ধারদেনা করেও ডলার কিনেছিলেন। পরে অবশ্য ডলারের দাম ১০০ টাকার নিচে নেমে এসেছিল।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL