সমুদ্রসীমায় ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক এলাকায় বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরেও নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। ব্লু-ইকোনমির অন্যতম সম্পদ হলো মাছ। অপরিকল্পিত ও ৪০ মিটারের মধ্যে মৎস্য আহরণের কারণে কমছে সামুদ্রিক মাছের মজুত। হুমকির মুখে রয়েছে সামুদ্রিক সাদামাছ, চিংড়ি ও পোয়া। এ কারণে নিয়ন্ত্রিত আহরণে জোর দিচ্ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক ‘বাংলাদেশ মেরিন ফিশ স্টক অ্যাসেসমেন্ট-২০২৩’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিট, চট্টগ্রামের ওয়েব সাইটে প্রকাশিক তথ্যে জানা গেছে, ফিনফিশ (সাদা মাছ) সমুদ্রে অনিয়ন্ত্রিত আহরণের কারণে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সাদা মাছ। যেখানে আগে ৩ লাখ ১ হাজর ১১৩ টন আহরণ করা হতো। চলতি বছর মজুত ও আহরণযোগ্য মাছের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার টন। যা আগের তুলনায় ৫১ হাজার ১১৩ টন কম। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি মাছ ও রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। আগে যেখানে ৪৬ হাজার ৩২৩ টন আহরণ করা হতো। বর্তমানে তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ হাজার টনে, যা আগের তুলনায় ৮ হাজার ৩২৩ টন কম। ক্রোকারস (পোয়া) এটি মধ্যম ঝুঁকিতে থাকলেও কমানো হয়েছে আহরণের লক্ষ্যমাত্রা। আগে যেখানে ৩৬ হাজার ৯২১ টন আহরণ করা হতো। বর্তমানে তা ৩৫ হাজার টন করা হয়েছে। যা আগের তুলনায় ১ হাজার ৯২১ টন কম আহরণ করতে হবে। এছাড়াও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সব মিলিয়ে আহরণযোগ্য মাছের পরিমাণ ৯ লাখ ৪৫ হাজার টন।
অন্যদিকে ইলিশ মাছ মধ্যম ঝুঁকিতে থাকলেও বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এ মাছের উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি করে ৬ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের যা আহরণ হতো গড়ে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৩৫৫ টন। এক্ষেত্রে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার ৬৪৫ টনের বেশি ধরা যাবে। বোম্বে হাঁস বা লইট্টা মধ্যম মাত্রার ঝুঁকিতে থাকলেও আহরণের লক্ষ্যমাত্রা আগের থেকে ৬ হাজার ৬৫৮ টন বৃদ্ধি করে ৭৫ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে আহরণ করা হতো ৬৮ হাজার ৩৪২ টন। পমফ্রেট বা রূপচাঁদার মজুত ভালো থাকার কারণে আগের থেকে বেশি মাত্রায় আহরণ করা যাবে। এটি আগে ১০ হাজার ৮৪১ টন আহরণ করা হলেও আগামী দিনে এ ধরনের মাছ ১৪ হাজার ৮৪১ টন বৃদ্ধি করে ২৫ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাসটেইনেবল কোস্ট্রাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের ডিপিডি এবং স্টক অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান ড. মোহাম্মদ শরিফুল আজম বলেন, মজুত জরিপ গ্রুপে আট জন সদস্য ছিলাম। আমাদের সহায়তা করেছেন স্কটল্যান্ডের মৎস্য গবেষক পল মেডলি। আমরা এখন বিদেশিদের সাহায্য ছাড়াই আগামী দিনে আমাদের স্টক অ্যাসেসমেন্ট করার সক্ষমতা অর্জন করেছি। আমরা আমাদের জরিপে ২০১০-২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের ল্যান্ডিং ডাটা এবং ‘আরভি মিন সন্ধানী’ জাহাজের মাধ্যমে জরিপ কাজ পরিচালনা করেছি। আমরা আমাদের জলসীমার ৪০ থেকে শুরু করে ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত জরিপ কাজ পরিচালনা করেছি। আমরা দেখেছি, ফিন ফিশ বা সাদা মাছের ক্ষেত্রে (ইলিশ এবং লইট্টা বাদে) সব মাছের মজুত নিয়ে কাজ করেছি। সেখানে আমরা খুব একটা ভালো ফল পাইনি। এক কথায়, আমরা ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছি। এ কারণে আমাদের আহরণ নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। আমরা গত ৫ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছি, যে সব জায়গায় মাছ বেশি পাওয়া যেত সেসব জায়গায় এখন মাছের প্রাপ্যতা কমে গেছে। চিংড়ির ক্ষেত্রেও একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে।
এ কারণে সাদা মাছ ও চিংড়ি আহরণে আগের থেকে বেশি নজর দিতে হবে যাতে করে অনিয়ন্ত্রিত আহরণ রোধ করা যায়। ইলিশের মজুত আমরা বেশ ভালো পেয়েছি। আপতত মধ্যম ঝুঁকিতে থাকলেও আমাদের উপকূলীয় এলাকা উর্বর এ মাছের জন্য, সে জন্য আহরণের মাত্রা আগের থেকে বৃদ্ধির জন্য বলা হয়েছে। লইট্টার ক্ষেত্রের মধ্যম রিস্ক থাকলেও ইলিশের মতো নয়। এক্ষেত্রে আগের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার থেকে অল্প কিছু বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমাদের জলসীমায় বেশ কয়েক প্রজাতির রূপচাঁদা রয়েছে। এগুলো আমাদের মজুত বেশ ভালো রয়েছে। এ কারণে আমরা আমাদের পূর্বের লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনকার আহরণ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বেশ সম্ভাবনাময় মাছ হতে পারে এই রূপচাঁদা। আমাদের আর একটি সাদা মাছ পোয়াও যদি মধ্যম ঝুঁকিতে থাকে তাহলেও আমরা দেখেছি এর মজুত কম হওয়ায় এ প্রজাতির মাছও নিয়ন্ত্রিত আহরণ করতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা আগের তুলনায় কমানো হয়েছে।
মাছের আধার কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ড. মোহাম্মদ শরিফুল আজম আরো বলেন, আমাদের উপকূলীয় এলাকায় সাধারণত ৪০ মিটার গভীরতায় মাছ ধরা হয়। যারা মাছ শিকার করেন তারা বেহুন্দি নামের এক ধরনের জাল ব্যবহার করেন, যে জালে সব ধরনের মাছ ধরা পড়ে। আর ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিস্তুত থাকে। যে মাছগুলো প্রয়োজন, সেগুলো রেখে বাকিগুলো তারা সমুদ্রে ফেলে দেন। এতে করে আমাদের উপকূলীয় এলাকায় মাছের আঁধার কমে যাচ্ছে। আর একটি দিক হলো জলবায়ু পরিবর্তন, বেশি ঠান্ডা, বেশি গরম এমন পরিবেশে অনেক প্রজাতি রয়েছে, যেগুলোর সঠিক পরিবেশের অভাবে প্রজনন সমস্যা হচ্ছে। চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায়, অন্য পরিবেশে। ফলে হুমকির মধ্যে রয়েছে অনেক প্রজাতির মাছ।
সাসটেইনেবল কোস্ট্রাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী বলেন, সুনীল সমুদ্র সম্পদে মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এ জন্য কাজ করছে সাসটেইনেবল কোস্ট্রাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আমরা কাজ করছি। আমাদের গবেষণা জাহাজ দিয়ে আমরা সমুদ্র মৎস্যসম্পদ নিয়ে গবেষণার কাজ করছি। সম্প্রতি আমরা শেষ করেছি আমাদের সমুদ্রে মাছের মজুত সংক্রান্ত গবেষণা। এখন আমরা এই মজুত ব্যবস্থাপনার ওপরে জোর দেব। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। যারা মৎস্য আহরণে নিয়োজিত, তাদের জানানো হবে কোন মাছ কী পরিমাণ সংগ্রহ করা যাবে? কোথায় কারা যাবে? কী অবস্থায় আছে? এছাড়া আমরা সমুদ্রে মৎস্য শিকারে নিয়োজিত সব বোট ও বাণিজ্যিক জাহাজ মনিটরিংয়ের কাজ করছি। সেন্টালি আমরা জানতে পারব কোনটি কোন জায়গায় অবস্থান করছে।
বিপদগ্রস্ত হলেও তাদের উদ্ধারে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ নিতে পারব। আমাদের আরেকটি সমস্যা হলো- আমাদের উপকূলীয় এলাকায় ই-লিগ্যাল বা চোরাই মৎস্য শিকারিদের প্রতিহত করা। এ জন্য আমরা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ছয়টি যান সংগ্রহ করছি; যা দিয়ে আমারা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় এলাকায় মনিটরিং জোরদার করতে পারব।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, বিশ্বে আহরিত সামুদ্রিক মাছের মাত্র ১ শতাংশ মাছ আমরা আহরণ করতে পারছি। আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে, যে সব জায়গায় আমরা দীর্ঘদিন মাছ ধরছি তা এড়িয়ে চলতে হবে। আমাদের এখন নজর দিতে হবে গভীর সমুদ্রে। উপকূলীয় এলাকা থেকে গভীর সমুদ্রের দিকে যেতে হবে। আমাদের বোট ও জাহাজগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দামি মাছ আহরণ করতে হবে। তবেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন অপ্রতুল কারণ অধিকাংশ সামুদ্রিক মৎস্য অগভীর সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় আহরণ করা হয়ে থাকে। জাহাজের সক্ষমতা ও যথাযথ ফিশিং প্রযুক্তির অভাবে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা হয় না। বর্তমানে আমাদের মৎস্য আহরণ উপকূল থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে সীমাবদ্ধ।
সুনীল অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য খাতের ২৫৫টি বাণিজ্যিক ট্রলার এবং ৬৭ হাজার ৬৬৯টি আর্টিসানাল নৌযান (যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক মৎস্য নৌযান) মৎস্য আহরণে ব্যবহƒত হয়। যাতে ১০-৪০ মিটার পানির গভীরে (গিল নেট, সেট ব্যাগ নেট, সাইন নেট, বুক ও লাইন ট্র্যামেল নেট) ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ৪০-১০০ মিটার পানির গভীরে বেশির ভাগ বাগদা চিংড়ি এবং ফিন ফিশ আহরিত হয়ে থাকে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL