রাজধানীর পশুর হাটগুলো সরগরম হয়ে উঠছে কোরবানির গরু, মহিষ ও ছাগলে। গতকাল বুধবার থেকে আনুষ্ঠানিক বেচাকেনা শুরু হয়েছে। চলবে ঈদের দিন পর্যন্ত। এদিকে ঈদের মাত্র তিনদিন বাকি, কিন্তু গতকালও হাটগুলোতে তুলনামূলক বেচাকেনা বেশ কম হতে দেখা গেছে।
এছাড়া বিভিন্ন অনলাইনে পশুর ওজন ও সহজে কেনাবেচার সর্বাধিক তথ্য থাকায় ক্রেতারও সেখান থেকে পশু ক্রয় করছেন। এতে হাটগুলোতে পশু বিক্রয়ের প্রভাব পড়েছে। একদিকে চাহিদার তুলনায় পশুর সংখ্যা বেশি, অন্যদিকে ক্রেতা না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় হাটের বিক্রেতা ও ইজারাদাররা।
এ বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় স্থায়ী হাট সারুলিয়া ছাড়াও অস্থায়ী আরো ১০টি হাট বসেছে। অন্য দিকে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় গাবতলী হাট ছাড়াও ৯টি হাট বসেছে। বাহারি নামের ও আকারের গরু নিয়ে বেপারিরা এসেছেন হাটগুলোতে। গাবতলীর স্থায়ী হাটসহ অস্থায়ী হাটগুলো কোরবানির পশুতে এখন কানায় কানায় পূর্ণ। রাজশাহীর রাজ, লাল তিমি, বাহুবলি, কালা চানসহ গরুর বিভিন্ন নাম দিয়ে বেপারিরা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু গরুর সাথে অনেকে খাশিও দিচ্ছেন ফ্রি। তবে প্রথম দিনে ক্রেতার সমাগম তেমন ছিল না।
ক্রেতারা বলছেন, গরুর দাম অনেক বেশি। মাঝারি গরুতে গতবছরের তুলনায় এবার দ্বিগুণ দাম চাওয়া হচ্ছে। দর কষাকষির পর কিছু ক্রেতা নিজের পছন্দের কোরবানির পশুটি নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ক্রেতারা এখনো ঘুরে ঘুরে হাটে পশু দেখছেন। তাদের বেশিরভাগেরই চাহিদা দেশি মাঝারি ও ছোট সাইজের গরু। গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় এবার গরুর দামও বেড়ে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
গাবতলী পশুর হাটের ক্রেতা সোহেল রানা জানান, কোরবানির জন্য গরু দেখতে এসেছি, কিন্তু পছন্দের গরুর অনেক দাম। এবার কোরবানির জন্য যে বাজেট রেখেছি তাতে পশু ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আরো ঘোরাফেরা করে শেষের দিকে একটি গরু কিনব।
গাবতলী হাটে গরু বেচাকেনা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে হাফিজ নামে এক বেপারি বলেন, পরপর দুই বছর লোকসান দিয়েছি। ভালো বিক্রি হলে এবার সে টাকা উঠবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তবে ক্রেতা সংকটে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। তারপরেও শেষ দিন পর্যন্ত দেখতে হবে। আসলে এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এ হাটে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বেপারি হামজা বলেন, ২ জুলাই ৪৮টা গরু আনছি। কিন্তু এখনো কোন গরু বিক্রি হয়নি। মানুষ শুধু দাম দর করে চলে যাচ্ছে। ক্রেতারা যে দাম বলছেন, তাতে গুরু বেচলে চালান অর্ধেক থাকবে না। এ অবস্থায় তিনি চালান রক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
রাজধানীর শাজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মৈত্রী সংঘ মাঠ ঘুরে দেখা যায়-এ বাজারে ৩৫ মণ ওজনের হলস্টেন ফ্রিজিয়ান জাতের একটি ষাঁড়ের মূল্য হাঁকা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। নাম তার রাজাবাবু। জামালপুরের ইসলামপুর থেকে রাজাবাবু নামে গরুটি নিয়ে এসেছে বেপারি লাল মিয়া। তিনি জানান, বিশাল এ ষাঁড়টিকে শুধু খৈল, ভুষি খাইয়ে পেলে-পুষে বড় করেছেন তিনি। ফলে খরচ হয়েছে বেশি। তাই এমন দাম চাচ্ছেন। হতাসা প্রকাশ করে এ বিক্রেতা বলেন, ষাঁড়টিকে এক নজর দেখার জন্য অনেকেই ভিড় জমালেও কোনো ক্রেতা এখনো দাম বলেননি। এ হাটে লাল মিয়া মোট ৩টি গরু নিয়ে এসেছেন। তার মতে হাটে পশুরু তুলনায় ক্রেতা অনেক কম। তবে বাকি সময়ের মধ্যে ভালো ক্রেতা পেলে তিনি গরুগুলো বিক্রি করে লাভবান হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
একই বাজারে জামালপুরের ঢালুচর এলাকা থেকে শহীদ মোট ১২টি গরু নিয়ে এসেছেন বিক্রির জন্য। এরমধ্যে একটি ষাঁড় রয়েছে যার ওজন ১৫ মণ। ‘জয় বাংলা’ নামে এ ষাঁড়ের মূল্য ৫ লাখ টাকা হাঁকিয়েছেন তিনি। কিন্তু আশানুরুপ ক্রেতার সারা না পেয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
মেরুল বাড্ডার আফতাব নগর হাটে লাখ টাকার নিচে গরু নেই। ইজারাদাররা হাটে এবারের কোরবানি ঈদে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার গরু বেচাকেনার প্রত্যাশা করছেন। এ পর্যন্ত হাটে অর্ধ লক্ষাধিক কোরবানির পশু এসেছে। এর মধ্যে গরুর দাম সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা। হাটে পর্যাপ্ত গরু, মহিষ ও ছাগল থাকলেও ক্রেতাদের উপস্থিতি একবারেই নেই।
হাট কর্তৃপক্ষ বলছে, এ বছর তুলনামূলক পশু বেশি, কিন্তু ক্রেতা কম। এভাবে চলতে থাকে হাটের ইজারা ও খরচের টাকা উঠবে কি-না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে বিক্রি পুরোদমে বিক্রি হওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আফতাব নগরে হাটের বিক্রেতা চুয়াডাঙ্গার আহাদ আলী বলেন, চার বছর ধরে এই হাটে গরু আনি। এবার এনেছি পাঁচটি। গতবার এনেছিলাম সাতটি, বিক্রি হয়েছিল পাঁচটি। আর দুটি বিক্রি হয়নি। এই দুটি বাড়িতে নিয়ে বিক্রি করেছি। এবার পাঁচটি এনেছি। ১৬ লাখ টাকা হলে বিক্রি করে দেব।
তিনি বলেন, পাঁচটি গরুর মধ্যে এক জোড়া ষাঁড় বিক্রি করার ইচ্ছে ১২ লাখ টাকা। তবে একটু কম বেশি হতে পারে। এই দুটির মধ্যে একটি ষাঁড়ের দাম চাইছি ৭ লাখ। এই ষাঁড়ে ২০ মণ মাংস হবে। জোড়ার অপর ষাঁড়টির দাম চাইছি ৫-৬ লাখ টাকা। এটাতে ১৬-১৭ মণ মাংস হবে। হতাশা প্রকাশ করে আহাদ আলী বলেন, প্রতিবার ঈদের ৪-৫ দিন আগে অর্ধেক গুরু বিক্রি করে দেই। কিন্তু এবার ক্রেতারা দাম শুনে চলে যাচ্ছে। এভাবে ক্রেতা ফিলে গেলে চালান বাঁচানো দায় হয়ে যাবে।
আফতাব নগর হাটের ইজারাদার মিজানুর রহমান ধনু বলেন, গত বছর হাটে ৪০ হাজার গরু এসেছিল। এর মধ্যে ২৫-৩০ হাজার বিক্রি হয়েছিল। ১০-১৫ হাজার অবিক্রীত ছিল। এবার হাটে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি গরু ছাগল এসেছে, আরো আসছে। আমাদের টার্গেট ৩০-৩৫ হাজার গরু কেনা-বেচার। তবে এখনো ক্রেতা সমাগম নেই বললেই চলে। যাও আসছে দাম দেখে দেখে চলে যাচ্ছে। আগামী দুদিনের মধ্যে বেচাকেনা বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করে। ধনু বলেন, এবার ১৫টি হাসিল রাখা হয়েছে। গরুগুলোর অবস্থা দেখার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসক রয়েছে। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক কর্মী রয়েছে। যখন যাদের যা প্রয়োজন ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
শাজাহানপুর হাটের ইজারাদার আব্দুল লতিফ বলেন, হাটে প্রচুর পশুর আমাদানি হয়েছে। হাটে যাতে ক্রেতা-বিক্রেতারা নিরাপদ থাকেন, তার জন্য এখানে শাজাহানপুর থানা পুলিশের একটি দল নিয়োজিত আছে। আমরা পুরো হাটে সিসিটিভির ব্যবস্থা করেছি। একই সঙ্গে জাল নোট শনাক্তকরণের জন্য একাধিক মেশিন স্থাপন করা হয়েছে।
লতিফ জানান, এখনো পুরোপুরি জমে উঠেনি হাট। যে পরিমাণ পশু এসেছে তুলনামূলক সে পরিমাণ ক্রেতা নেই। এতে বিক্রেতাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমরা এখনো আশা করছি, বৃহস্পতিবার থেকে বিক্রি ভালো হবে।
এদিকে, এবার ঈদুল-আজহায় দেশে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদার চেয়েও প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ পশু বেশি আছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা ছোট-বড় খামারিদের উৎপাদিত গবাদি পশুর সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মেহেরপুরে কোরবানির চাহিদা চেয়ে উদ্বৃত্ত রয়েছে ৯৮ হাজার পশু। কোরবানির জন্য এবার জেলার ৪০০টি বাণিজ্যিকসহ পারিবারিকভাবে ২৮ হাজার খামারে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৮৬টি পশু কোরবানিযোগ্য হয়েছে। জেলায় কোরবানির চাহিদা ৮৯ হাজার ৮২০টি। উদ্বৃত্ত পালন হয়েছে ৯৭ হাজার ৯৬৬টি।
বগুড়ায় রয়েছে ৬৮ হাজার কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত। গত কয়েক বছর ধরে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে চোরাপথে পশু না আসায় দেশে গো-খামারিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৭৫টি। এবার প্রায় ৬৮ হাজার পশু উদ্বৃত্ত থাকবে বলে জানান, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সাইফুল ইসলাম।
জয়পুরহাটে কোরবানির চাহিদার চেয়ে প্রায় ৫০ হাজার উদ্বৃত্ত পশু রয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্র জানায়, জেলার কোরবানির চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৫০ হাজার পশু পশু উদ্বৃত্ত।
কুমিল্লা জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়- জেলায় চাহিদার চেয়ে ১০ হাজারের অধিক বেশি পশু মজুত রয়েছে। ঈদে জেলার পশুর চাহিদা ২ লাখ ৪৮ হাজারের মধ্যে বর্তমানে জেলায় পশুর মজুত রয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৩২টি।
নোয়াখালীতে কোরবানির চাহিদার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, জেলায় সাড়ে ৬ হাজার খামারি রয়েছে। এতে কোরবানির ঈদের জন্য ৯৯ হাজার গরু-মহিষ ও ছাগল রয়েছে। চাহিদার তুলনায় ১০ হাজার বেশি।
ফেনীতে কোরবানির চাহিদার চেয়ে প্রায় ৭ হাজার পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আনিসুর রহমান জানান, এ বছর জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ৭৫ হাজার, চাহিদার চেয়ে প্রায় ৬ হাজার ৯৩৮টি পশু অতিরিক্ত রয়েছে।
রাঙ্গামাটিতে কোরবানির চাহিদার চেয়ে প্রায় ৫ হাজার পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বরুন কুমার দত্ত বলেন, জেলার স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও আরো প্রায় ৫ হাজারের মতো উদ্বৃত্ত থাকবে।
টুঙ্গিপাড়ায় চাহিদার উদ্বৃত্ত কোরবানির পশু উৎপাদিত হয়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. প্রকাশ বিশ্বাস জানান, চাহিদার তুলনায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এবার উদ্বৃত্ত পশুর সংখ্যা ৭৩৭ টি।
অন্যদিকে, রাজধানীর হাটগুলোতে সিটি করপোরেশন ও ইজারাদারদের বিরুদ্ধে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেন বেপারিরা। হাটেরই বড় সমস্যা মশা-এমনটাই অভিযোগ করে বেপারিরা। তাই বেশি দামের মশার কয়েল না কিনে, খড় পুড়িয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তার ওপরে দিন যত গড়াচ্ছে ভিড়ও বাড়ছে। সব মিলিয়ে যেন গাদাগাদি দশা। মশার উৎপাতে গরু আর মানুষ উভয়েরই টিকে থাকা দায়। এছাড়া রয়েছে পানি ও টয়লেট সংকট। মশায় অতিষ্ঠ গরু বিক্রেতারা বলেন, মশার জন্য দাঁড়ানো যাচ্ছে না। গরু বাছুরেরও সমস্যা হচ্ছে। শত চেষ্টার পরও মশা যায় না।
হাটের বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ বলেন, যারা হাটগুলো ইজারা নিয়েছেন, আগত ক্রেতা এবং দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে তাদের আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।
এ বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মাহে আলম বলেন, কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপদ এবং সহজ লেনদেন নিশ্চিত করতে স্মার্ট হাটের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় ডিএনসিসির ছয়টি পশুর হাটে ডিজিটাল পেমেন্ট বুথ উদ্বোধন করা হয়েছে। এই উদ্যোগ ক্রেতা-বিক্রেতাদের নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি, নকল বা ছেঁড়া/ফাটা নোট-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL