নিজস্ব প্রতিবেদক:
আসন্ন গ্রীষ্মে চতুরমুখী সংকটে পড়তে পারে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। মার্চ মাস থেকে শুরু হবে গরমের মৌসুম। সেই সাথে রমজান, সেচের জন্যও বাড়বে বিদ্যুতের চাহিদা। তাই গ্রীষ্মে বিদ্যুতের দৈনিক সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ানোর পূর্বাভাস দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ অবস্থায় বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট মোকাবিলা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতি, চলমান ডলার সংকট, পুঞ্জিভূত বকেয়া, গ্যাস-কয়লাসহ জ্বালানির ঘাটতি, এবং পায়রার মতো সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র বন্ধ থাকায় দেশের বিদ্যুৎ খাতকে গত দুই বছর ধরে ধুঁকতে হয়েছে। যার ফলে চরম লোডশেডিংয়ে নাকাল হন দেশের সব প্রান্তের গ্রাহক। শীতের মৌসুমে বিদ্যুৎ নিয়ে স্বস্তিতে ছিল সর্ব মহল। বছর ঘুরে আবারও যখন ঘনিয়ে আসছে গরম, তখন উঁকি দিচ্ছে সংকটের সংশয়। গরম, রমজান এবং সেচ মৌসুমের কারণে আগামী মাস থেকেই পাল্লা দিয়ে বাড়বে বিদ্যুতের চাহিদা। বিদ্যুৎ বিভাগের পূর্বাভাস, আগেরবারের তুলনায় প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বেড়ে চলতি মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। গত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হলো ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। গত বছর ১৯ এপ্রিল উৎপাদন হয়েছিল এ পরিমাণ বিদ্যুৎ। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২৫ হাজার ৪৯১ মেগাওয়াট।
দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার দেনা নিয়ে বিপাকে পড়ে আছে সরকার। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, দেশে উৎপাদনরত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৫০ কোটি ডলারের মতো (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা)। জ্বালানি তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা)। আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। এর বাইরে আরও কিছু খাতে বকেয়া রয়েছে। সবমিলিয়ে মোট দেনার পরিমাণ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। একদিকে সরকার টাকার অভাবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না, অন্যদিকে ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা।
তবে ১১ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়লেও, জ্বালানি সংস্থানে রাতারাতি বড় কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। এর ওপর আরেক ভাবনার কারণ ডলার নিয়ে টানাটানি। এবার সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন ১ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল, ১৫ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন ডিজেল এবং দৈনিক কয়লার চাহিদা ৩০ হাজার টন। যার জন্য লাগবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ছাড়।
এছাড়া এবার বিদ্যুৎ বিভাগের দৈনিক চাহিদা ১৫৪ থেকে ১৭৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। যেখানে গতবার বিদ্যুৎ খাতে ১১০ থেকে ১২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস জুগিয়েই হাঁপিয়ে যায় জ্বালানি বিভাগ। সে কারণেই এবার সংশ্লিষ্টদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
একদিকে অভ্যন্তরীণ খাতে অপর্যাপ্ততা। অন্যদিকে সংকটময় বৈশ্বিক বাস্তবতা। এমন প্রেক্ষাপটে চলতি বছরও চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের জ্বালানি খাত। সেই ক্ষেত্রে কৌশলী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে না পারলে সাম্প্রতিক বছরের মতো চলতি মৌসুমেও সংকটে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
এবিষয়ে আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরামর্শক প্রকৌশলী সালেক সুফী গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এবং পেট্রোবাংলার প্রচুর বকেয়া পড়ে রয়েছে। বর্তমানে পুরো সিস্টেমেই বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম বলেন, এলএনজির (তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ওপর যদি ব্যাপকভাবে নির্ভর করা হয়, তাহলে যে আর্থিক চাপ পড়বে, সেটি বাংলাদেশের এই ডলার সংকটের সময়ে বড় রকমের অসুবিধার মধ্যে ফেলবে জ্বালানি বিভাগকে। সুতরাং, আমাদের এ সমস্যা আসন্ন গ্রীষ্মে বড় আকারে হয়ে আসার পূর্বাভাস দিচ্ছে। কাজেই, এখন থেকেই আমাদের উচিত হবে দেশীয় যেসব গ্যাসকূপ রয়েছে, সেগুলোর উৎপাদন যাতে আরও না কমে যায়, তা নিশ্চিত করা। সেগুলো থেকে উৎপাদনের মাত্রা সমানতালে রাখা বা সম্ভব হলে আরও বাড়াতে হবে।
পরিস্থিতি সহনীয় রাখার আশ্বাস দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিনি বলেন, আমরা যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চাই, তাহলে সময়মতো অর্থের জোগান দিতে হবে। এটি নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি। আমরা ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আশাবাদী যে ভালো অবস্থানে থাকব।
এরই ধারাবাহিকতায় সংকটময় পরিস্থিতিতে জ্বালানি আমদানি স্বাভাবিক রাখতে ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) সঙ্গে ২১০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করেছে জ্বালানি বিভাগ।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL