কোরবানিতে যত পশুর চাহিদা হওয়ার কথা, চলতি বছরে তার চেয়ে ২০ লাখ কোরবানির পশু বেশি রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তাই তারা দাবি করছে, এবারের ঈদে চাহিদার চেয়ে কোরবানি পশুর বেশি থাকায় কোনো সঙ্কট হবে না। আর অন্যান্য বছরের মতো এবারও ভারত, মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ থাকলে নিজেদের পশু দিয়েই কোরবানির শতভাগ চাহিদা পূরণ হবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল। তবে বিশ্ববাজারে গমের দাম বৃদ্ধিতে কোরবানি পশুর দাম বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বাজার বিশ্লেষকরা।
এবিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, গত দুই বছর করোনার প্রকোপের কারণে পশু কোরবানি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। যদিও এবার নতুন করে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, তবু আমরা আশা করছি এবার কোরবানি দেওয়ার হার বাড়তে পারে। তবে চাহিদা বাড়লেও দেশে কোরবানির পশুর কোনো সঙ্কট হবে না, বরং কোরবানি দেওয়ার পরও উদ্বৃত্ত থাকবে প্রায় ২০ লাখ পশু।
তিনি আরো বলেন, খামারিরা যাতে তাদের পশুগুলো বিক্রি করতে পারে তার জন্য অনলাইনে পশু বিক্রিতে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন অনলাইন মার্কেট প্লেস থেকে শুরু করে খামারিরাও নিজ উদ্যোগে অনলাইনে পশু বিক্রির উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকেও এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। গতবছরও অনলাইন প্ল্যাটফরমে কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ উদ্যোগের কারণে গতবছর অনলাইনে অনেক পশু বিক্রি হয়।
এক হিসেবে দেখা গেছে, গত ৬ বছরের ব্যবধানে দেশে বেড়েছে প্রায় ৬ লাখ গরু-ছাগলসহ কোরবানিযোগ্য অন্যান্য পশুর সংখ্যা। তবে আগের তিন বছরের চেয়ে সর্বশেষ গত দুই বছর কোরবানি দেওয়ার সংখ্যা কমেছে ১৫ লাখেরও বেশি। মূলত মহামারি করোনার কারণেই গত দুই বছর কোরবানি দেওয়ার হার কমেছে। গতবছর কোরবানি দেওয়া হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু। তবে এ বছর পরিস্থিতি গত দুই বছরের চেয়ে ভালো হওয়ায় এবার কোরবানি দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি পশু। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর কোরবানির জন্য গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে পশুরহাটের সংখ্যা। বেসরকারি উদ্যোক্তার পাশাপাশি সরকারিভাবে অনলাইন প্ল্যাটফরমে কোরবানির পশু বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এরমধ্যে প্রায় ২৮ লাখ গবাদি পশু বিক্রি হয়নি। খামারি-ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়ার সংকট নেই। ঈদুল আজহা ২০২২ উপলক্ষে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের ৮টি বিভাগে খামার রয়েছে ৬ লাখ ৮১ হাজার ৫৩২টি। এসব খামারে কোরবানিযোগ্য গরু আছে ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৯টি, মহিষ আছে এক লাখ ৭৩ হাজার ৫০৪টি, ছাগল আছে ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৫টি, ভেড়া আছে ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬৮২টি। বিভাগওয়ারি গবাদি পশুর চাহিদা ও প্রাপ্যতা অনুসারে ঢাকায় চাহিদা ২৪ লাখ ৭ হাজার ১৯৬টি গবাদি পশুর। ঢাকায় প্রাপ্যতা সংখ্যা ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫০টি, ঘাটতি রয়েছে ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৬৪৬টি পশু। চট্টগ্রামে চাহিদার সংখ্যা ২০ লাখ ৪১ হাজার ৯৮২টি, প্রাপ্যতা রয়েছে ২০ লাখ ১৯ হাজার ৯০৪টি, ঘাটতি রয়েছে ২২ হাজার ৭৮টি। রাজশাহী বিভাগে চাহিদা ১৯ লাখ ৭০ হাজার ৬৩১টি। এই বিভাগে গবাদি পশু রয়েছে ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৪টি। ফলে উদ্বৃত্ত থাকছে ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৩টি। খুলনা বিভাগে চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯০০টি। বরিশাল বিভাগে পশুর চাহিদা ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৭টি, প্রাপ্যতার সংখ্যা ৬ লাখ ৭২ হাজার ৪৯৯টি, উদ্বৃত্ত থাকছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭২টি। সিলেটে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮০৯টি গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া রংপুরে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ৭ লাখ ৬৭ হাজার ১০১টি, ময়মনসিংহে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৭১টি কোরবানিযোগ্য গবাদি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীনে ৬টি কোরবানির পশুরহাটে ডিজিটাল লেনদেনের ব্যবস্থা করেছে ডিএনসিসি ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
হাটগুলো হলো-গাবতলী, বসিলা, আফতাবনগর, ভাটারা, কাওলা ও উত্তরা ১৭নং সেক্টরের পশুরহাট। সংশ্লিষ্টরা জানান, পবিত্র ঈদুল আজহায় পশুর হাটে নগদ অর্থের লেনদেন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। হাটকে কেন্দ্র করে বেড়ে যায় জাল নোট, ছিনতাই ও বিভিন্ন প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড। আসন্ন ঈদুল আজহায় এসব সমস্যা এড়াতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ স্মার্ট হাট’ পাইলট প্রকল্পটি চালু করতে যাচ্ছে সরকার। প্রকল্পটি পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) যৌথভাবে কাজ করছে। সার্বিক সহায়তা করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন। এই প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে হাট সংশ্লিষ্ট ৩টি এলাকায় প্রান্তিক খামারিদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, দেশে পর্যাপ্ত গবাদি পশু রয়েছে। কোরবানির জন্য দেশে কোনো পশু আমদানির প্রয়োজন হবে না। আমদানি বন্ধ রয়েছে।
এ বছরও আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে সরকার অটল। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এসোসিয়েশনের শাহ এমরান বলেন, আমাদের সংগঠনে ১৮ হাজার সদস্য রয়েছে। তাদের ফার্মে প্রায় তিন লাখ পশু মজুত রয়েছে। এছাড়া গ্রামেগঞ্জে গৃহস্থি গরু রয়েছে। সব মিলেয়ে এক কোটির বেশি হবে। এসব গবাদি পশু নিয়ে কোরবানি চাহিদা পূরণ হবে। এদিকে গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারা দেশে ৪ হাজার ৪০৭টি গবাদি পশুর হাট বসবে। আর এসব হাটে মাস্ক ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না। তবে হাটের সংখ্যা দু-একটা বেশি-কম হতে পারে। মহাসড়ক ও সড়কে কোনো পশুর হাট বসানো যাবে না।
কোরাবানি ঈদের বাকি আর মাত্র ৭ দিন। এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমে উঠেছে পশুরহাট। রাজধানীতে আসতে শুরু করেছে কোরবানির পশু। দুই সিটি করপোরেশনের ১৯টি হাটে ৫ই জুলাই থেকে শুরু হবে বেচাবিক্রি। হাটের পাশাপাশি অনলাইনেও পশু বেচাকেনার ব্যবস্থা রাখছে সরকার। কোরবানিকে ঘিরে দেশে প্রস্তুত করা হয়েছে এক কোটি ২১ লাখ পশু। এ বছর সারা দেশে ৪৪০৭টি স্থানে বসবে পশুরহাট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- দেশের উৎপাদিত পশুতে কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণ করা হবে। গত বছরও দেশীয় গরুতে চাহিদা মেঠানো সম্ভব হয়েছে। ২০২১ সালে সারা দেশে কোরবানি হয়েছিল ৯১ লাখ পশু।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL