রেজাউল করিম হীরা
জোটবদ্ধভাবেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। জোটে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া জাতীয় পার্টিও এখন এই জোটে ভিড়তে চায়। ১৪ দলের শরিক নেতারা নৌকা নিয়েই ভোট করতে চান। লাঙল ছেড়ে নৌকায় চড়ে নির্বাচন করতে চান এরশাদের দলের নেতারাও। এ নিয়ে বিশাল জট লেগেছে জোটে।
একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা ২৩। আর ১৪ দলের শরিকদের আসন ৮টি। এবার শরিকদের প্রত্যাশা দ্বিগুণ। আসন সমঝোতায় পিছিয়ে নেই জাতীয় পার্টিও। তাদের দাবি এবার শতাধিক আসন।
যদিও সম্প্রতি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, জাতীয় পার্টি এত দিনে সাবালক হয়েছে। এবার সাহস করে এককভাবে নির্বাচন করছে। অর্থাৎ ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল থেকে এবারে তারা ‘সত্যিকার’ বিরোধী দল হতে চাইছে।
আবার ভয়ও আছে। আওয়ামী লীগ যদি ছাড় না দেয়, আসন ধরে রাখা কঠিন হবে। তাই তারাও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চায়। তাদের ধারণা-আসন ভাগাভাগির ভোটে সহজে নৌকায় চড়ে ক্ষমতার বন্দরে ভেড়া যাবে।এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেন দরবার চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তবে সবকিছু চ‚ড়ান্ত হবে ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শরিক দলগুলোকে আসন কম ছাড় দিতে পারে। শরিক দলগুলোর মধ্যে চার নেতার আসন অনেকটা নিশ্চিত হলেও অন্যদের বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি।
আসন বন্টন নিয়ে গত সোমবার সন্ধ্যায় গণভবনে ১৪ দলীয় শরিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জোটের প্রধান ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
বৈঠকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন আলোচনা তুলেছিলেন, শরিকদের দেওয়া নৌকা প্রতীকের আসনে যেন আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, শরিকদের যেসব আসন ছেড়ে দেওয়া হবে সেখানে নৌকা প্রতীকে তাঁরাই নির্বাচন করবেন। আওয়ামী লীগের অন্য কোনো প্রার্থী থাকবেন না। তবে আওয়ামী লীগের বা অন্য কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে তাঁদের দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বসতে বলার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর আধিক্য যেমন আছে তেমনি থাকবে। দল থেকে একজনকে জেতানোর জন্য অন্যজনকে বসতে বাধ্য করা হবে না।
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৯টি দল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বাকি ১৫টি দল তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট শরিকদের মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৯১, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২০, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) ছয়, গণতন্ত্রী পার্টি ১২, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ছয়, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৩৩, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ৪৭টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। এছাড়া এরশাদের জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েছে ২৮৯ আসনে।
জাপার নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একদিকে দলীয় মনোনীত প্রার্থী দিয়েছে। অন্যদিকে প্রায় সব আসনে একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখে নির্বাচনের মাঠ জটিল করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নামে-বেনামে থাকা প্রার্থীদের সরিয়ে না নিলে জাপার নির্বাচনে জেতার সুযোগ কম। তাই জাপার অধিকাংশ নেতাই ভোটে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে জয়ী হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নন। এ ক্ষেত্রে দলের বর্তমান সংসদ সদস্যসহ নেতাদের বড় একটি অংশ গত দু’বারের মতো এবারও সরকারের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে যেতে চান। কারণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও তাঁদের জেতার সম্ভাবনা নেই। তাঁরা সমঝোতার মাধ্যমে ভোট করে সহজে জিততে চান। এই অংশ এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে কোনো সমঝোতার উদ্যোগ না দেখে অস্বস্তিতে রয়েছে।
দলটির একটি সূত্র জানায়, নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগে থাকা জাপার নেতাদের বড় একটি অংশ সংসদ সদস্য হতে সরকারের সঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করছে। এই চেষ্টায় খুব সাড়া না পাওয়ায় সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে তারা এরই মধ্যে বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে বলছেন, নৌকা প্রতীক না দিলে এবার তারা নির্বাচন করবেন না। যাতে সরকার জাপার সঙ্গে আসন ভাগাভাগি বা নির্বাচনী সমঝোতার উদ্যোগ নেয়। আসন সমঝোতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিগগিরই জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে জাপার জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হতে পারে। সেটি কবে কখন, বলতে পারব না। (প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে) দেখা হলে নির্বাচন কীভাবে হবে, নির্বাচনটা যাতে সঠিক ও যথাযথ হয়, সে কথা বলব আমরা।’
২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে অংশ নেয় জাপা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি ২২টি আসনে ও ২০১৪ সালে ২৯টি আসনে জয়ী হয়।
জাপা সূত্রে জানা গেছে, সরকারি দল সমঝোতার উদ্যোগ নিলে আসন্ন নির্বাচনে জাপা কমপক্ষে ৪০টি আসন দাবি করবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ১৪ দলের শরিকদের আসন ভাগাভাগির বিষয়টি জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে চূড়ান্ত হবে।
জাপার সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচন করার আভাস দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদও। তিনি গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় পার্টি প্রায় ৩০০ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে। তারা যেভাবে নির্বাচনযুদ্ধে নেমেছে, সে জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই। জাতীয় পার্টির সঙ্গে ২০০৮ সালে আমরা জোটগতভাবে মহাজোট গঠন করেছিলাম, গতবারও তারা আমাদের সঙ্গে ছিল, এবারও সেটি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা হওয়ার আগে আসন ভাগাভাগি সম্পর্কে কিছু বলতে চান না আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জাতীয় পার্টি একসময় আমাদের মহাজোটে ছিল। তারা নির্বাচন করছে। সুতরাং আলোচনা হওয়ার আগে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
তবে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বর্তমান নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমির হোসেন আমু ফোন করেছিলেন। ওবায়দুল কাদের আমাদের (জাতীয় পার্টি) চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে আসন ভাগাভাগির কোনো প্রস্তাব দেননি। সমঝোতার মতো কিছু হলে তা মনে মনে হতে পারে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL