২৪-নভেম্বর-২০২৪
২৪-নভেম্বর-২০২৪
Logo
জাতীয়

টালমাটাল ডলার বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২২-০৮-১১ ১৭:১৯:১৯
...

পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছে ডলারের দাম।  তীব্র সংকটের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে কমপক্ষে ২৫ টাকা বেশিতে ১২০ টাকায় খোলাবাজারে কিনতে হচ্ছে প্রতি ডলার।  দেশের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি।  এদিকে ছুটে চলা ডলারের দৌড় থামাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।  তারপরও কমছে না মুদ্রাটির তেজী ভাব, কাটছে না সংকট।  চাহিদা মেটাতে অনেক ব্যাংক উল্টো খোলাবাজারে ডলার খুঁজছে।

গত ২৭ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের দর উঠেছিল ১১২ টাকা।  এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির পর কয়েক দিন সেখান থেকে কিছুটা কমে ১০৮ টাকায় থিতু হয়।  কিন্তু চলতি সপ্তাহ থেকে আবার শুরু হয় ঊর্ধ্বগতি।  গত সোমবার খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয় ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায়।  তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দর সেদিনও ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা।  পরদিন তা আরও ৩০ পয়সা বাড়িয়ে করা হয় ৯৫ পয়সা।  এরপর দিন খোলাবাজারে আবার লাফ দেয় ডলার।  একদিনে বাড়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা।

খোলাবাজার ব্যবসায়ীরা বলছেন, তীব্র সংকট রয়েছে ডলারের।  প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশি পর্যটকরাও কম আসছেন।  এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম।

গতকাল বুধবার দিলকুশা দোহার মানি এক্সচেঞ্জে ডলার কিনতে আসা এক ক্রেতা বলেন, প্রতি ডলার ১২০ টাকা চাচ্ছে।  প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।  ব্যাংকে গিয়েও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।  ব্যাংকগুলো বলছে ডলার নেই।

দীর্ঘদিন খোলা বাজারে ডলার বিক্রি করেন মজিদ মিয়া।  গতকাল বুধবার সকালে ডলারের রেট কত জানতে চাইলে বলেন, এখন ডলার নেই, কেউ বিক্রি করলে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা রেট দেব।  বিক্রির রেট কত জানতে চাইলে বলেন, না থাকলে রেট দেব কীভাবে।  একই কথা বললেন মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জের কর্মী মাহমুদ।  তিনি জানান, বাজারে ডলার নেই।  কেউ কিনলে ১১৯ টাকা দিতে হবে।  তাও এক ঘণ্টা লাগবে।  কারো কাছ থেকে এনে দিতে হবে।

খোলা বাজারের ডলার ব্যবসায়ী ও মানি এক্সচেঞ্জের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ মানি এক্সচেঞ্জেই এখন নগদ ডলারের সংকট চলছে।  বিক্রির চেয়ে তারা কিনছে বেশি।  তবে বিক্রি করার লোক নেই।  আবার এতদিন যারা রাস্তায় ডলার কেনাবেচা করতেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ভয়ে তারাও সরাসরি কেনাবেচা করছেন না।

গতকাল সকালে কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে নগদ ডলার কিনতে গ্রাহককে গুনতে হয় ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা।  সোমবার যা ছিল ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা।  খোলা বাজারে সাধারণ গ্রাহক বিক্রি করলে প্রতি ডলার পাচ্ছে ১১৫ টাকা থেকে ১১৬ টাকা।  পল্টনের খুচরা ডলার ব্যবসায়ী বেলাল জানান, খোলা বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। তীব্র সংকট চলছে।
আব্দুর রশিদ নামে মতিঝিলের এক ডলার বিক্রেতা বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে থেকে এনে নগদ ডলার কেনা-বেচা করি।  যারা বিদেশ যান তাদের খুচরা কিছু ডলার লাগে।  ব্যাংকে গেলে বিভিন্ন ঝামেলা হয়।  আমাদের কাছ থেকে সহজে ডলার কিনতে পারে।  খুচরা ৫০, ১০০ থেকে ১০০০ ডলার কেনা-বেচা করি।  যারা বিদেশ থেকে খুচরা ডলার নিয়ে আসেন তারা আমাদের কাছে বিক্রি করেন।  আবার অনেকে ডলার নিয়ে বিদেশে যান, সব খরচ হয় না, তারাও ফেরত দেন।  প্রতিদিন দুই তিন হাজার ডলার বিক্রি হয়।  বাজার ভালো থাকলে এক দেড় হাজার টাকা পাই।  এখন বাজারে ডলারের চাহিদা আছে।  কিন্তু ডলার নেই।  দামেরও ঠিক নেই।  আবার ভয় আছে।  আগে সরাসরি বিক্রি করলে কোনো সমস্যা হতো না।  এখন পুলিশে ধরছে।  তাই ব্যবসা করা সমস্যা।

ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে কয়েক মাস ধরে।  দুই মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ; এক বছরে বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি।  বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ মাস ৮ দিনে (১ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট) বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ১৫০ কোটি (দেড় বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত সোমবারও রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তেল আমদানি এবং বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

এ হিসাবে এই ১ মাস ৮ দিনে গড়ে প্রতিদিন ৪ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।  এর আগে কখনোই এত কম সময়ে ব্যাংকগুলোর কাছে এত বেশি ডলার বিক্রি করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি উল্লম্ফন ও আমদানি ব্যয় কমায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণেই বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে।  সেই চাহিদা পূরণের জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলার ছাড়া হচ্ছে।

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশে ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে।  প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম।  এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে।  তারপরও সংকট কাটছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, ব্যাংকগুলোতে তার চেয়ে ৭ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে।  ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।

অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০৫ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে।  বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অনেক ব্যাংক ১১০ টাকা দিয়ে ডলার সংগ্রহ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

ডলার বিক্রির কারণে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ চাপের মধ্যে রয়েছে।  গত সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।  জুলাই মাসের ৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

গত ১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।  চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির ফলে আরও কমে গেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক।

মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমদানি অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্য, জ্বালানি, শিল্পের উপকরণের দর বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়।  আর দাম বাড়তে থাকায় এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে অবৈধভাবে মজুত করার তথ্য মিলছে।

খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে রাজধানীর বিভিন্ন মানি চেঞ্জারে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।  জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  পাশাপাশি অবৈধভাবে ডলার মজুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।  ফলে ডলারের বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এখন নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে।  তবে সব চেষ্টাই এখন নিষ্ফল।  ডলার কারসাজির অভিযোগে গত সোমবার দেশি-বিদেশি ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  ব্যাংকগুলো হলো- বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।  এছাড়া গত সপ্তাহ পর্যন্ত কারসাজির অপরাধে পাঁচ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।  পাশাপাশি ৪২টিকে শোকজ করা হয়েছে।  এছাড়া লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করায় ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে।