এম এ বাবর:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিলে পরিবর্তন আসতে পারে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনা ও শেষবেলায় নিজেদের আরেকটু গুছিয়ে নিতে চাইছে সরকার। এরমধ্যে ঘোষিত তফসিল পেছানোর ইঙ্গিতও দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনিছুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংগঠিত হচ্ছে বিরোধীদলগুলো। একাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু দেশের বড় বিরোধী দল বিএনপি এখনও ঘোষিত তফসিলে নির্বাচনে অংশ নিতে নিজেদের সংগঠিত করছে না। তবে তফসিল পিছিয়ে বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ভাবছে ইসি ও সরকার।
বাংলাদেশে একাদশ সংসদের মেয়াদ ২০২৪ সালের ২৯শে জানুয়ারি শেষ হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। আর এজন্য পরবর্তী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। রেওয়াজ অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণের দিনের মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ দিনের পার্থক্য থাকে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সাতই জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত ৪৪ দিন সময় থাকছে। এর মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ১৮ই ডিসেম্বর থেকে পাঁচই জানুয়ারি পর্যন্ত ১৯ দিন সময় থাকবে। কিন্তু তফসিল মানে শুধুই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নয়। এর সঙ্গে আরো অনেকগুলো কাজ থাকে। নির্বাচন আয়োজন করার জন্য যেসব কাজকর্ম জড়িত রয়েছে তার সবকিছুর জন্যে একটি সময় বেধে দেয়া হয় তফসিলে।
নির্বাচন কমিশন চাইলে সংসদ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ওই ৯০ দিনের মধ্যে দেয়া নির্বাচনের তারিখ বদলাতে পারে। যদি সেটি দরকার হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের সেই এখতিয়ার রয়েছে। সেক্ষেত্রে তফসিল সংশোধন করে দেয়া যায়। এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য তারিখগুলো পরিবর্তন করে দিতে পারে কমিশন।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনিছুর রহমান গতকাল বুধবার কুমিল্লা সার্কিট হাউসের এক মতবিনিময় সভা শেষে বলেন, শোনা যাচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে আসতে চাচ্ছে। এখন যদি তারা পর্দার অন্তরালে আলাপ-আলোচনা করে তাহলে তফসিল পেছানোর সুযোগ আছে।
দুপুরে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিন জেলা প্রশাসক, রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ইসি আনিছুর রহমান বলেন, নির্বাচনে কে আসলো কে আসলো না, এটা আমাদের বিষয় নয়। কাউকে নির্বাচনে আনাও আমাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের নিবন্ধিত ৪২টি দল আছে। তাদের আমরা চিঠি দিয়েছি। আমাদের এক নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, বড় রাজনৈতিক দলটি (বিএনপি) নির্বাচনে এলে তফসিল পেছানো নিয়ে সংবিধানে সুযোগ আছে। আমরা আগে থেকে আহ্বান করে যাচ্ছি, নির্বাচনে সবাই আসুক। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। তবে সংবিধান অনুযায়ী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে।
অন্যদিকে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, তফসিল পেছালে আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই। তফসিল পেছানো বা নির্বাচনের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত। সময়সীমার মধ্যে তারা তাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন। এখানে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কিছু বলার নেই। নির্বাচনের বিষয়ে ৩০ নভেম্বর পর সব কিছু স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন কিভাবে করবে সেটি পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। নির্বাচন সম্পন্ন করার একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। এ সময়সীমার ভেতরে থেকে ভোট সম্পন্ন করতে হবে। এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে ভোট কিছুদিন পেছানো দরকার সেটি তারা করতে পারে। এখানে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কিছু বলার নেই। বিএনপি না এলে, একটি দলকে ঘিরে তো নির্বাচনে সিদ্ধান্ত হতে পারে না। অন্য দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
গতকাল সকাল ১১টায় কমনওয়েলথ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ নেতারা। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খানসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ আরো কয়েক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় পার্টি। একই সঙ্গে কোনো জোট নয়, ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথা জানিয়েছে দলটি। গতকাল বিকাল সোয়া ৩টায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে দলের পক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। এ সময় তিনি বলেন, জাতীয় সাংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমরা আমাদের সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছি। কিন্তু আমরা নির্বাচনে যাব কি যাব না, তা ঘোষণা করা হয়নি। আমরা সব সময় বলেছি, আমরা একটি আস্থার পরিবেশ চাই। ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন। নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব মাধ্যম থেকে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি, নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে।
ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট মহল আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তাদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রেখে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে- আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা করছি।
চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টি কোনো জোটে যাবে না, তিনশ’ আসনেই নির্বাচন করবে। দুপুর পর্যন্ত আমাদের প্রায় ১৪শ’ মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক আসনেই একাধিক আগ্রহী প্রার্থী মনোনয়ন ফরম গ্রহণ করেছেন। আমরা আমাদের ঘোষণা অনুযায়ী এককভাবেই নির্বাচন করব। আমরা কারো সঙ্গে আসন সমঝোতায় যাব না।
অন্যদিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে নতুন রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্ট। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগে এক সংবাদ সম্মেলনে ফ্রন্টের প্রধান ও কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এ ঘোষণা দেন। এর আগে তিনটি দলের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই জোটের নাম যুক্তফ্রন্ট। নতুন এই জোটের তিনটি দল হলো: বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (হাতঘড়ি), জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল) এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (হাতপাঞ্জা)।
সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে আমরা অংশ নিবো। আশা করছি- আগামী নির্বাচন অতীতের চেয়ে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার হবে। তাই আমরা আবেদন করছি, সরকার যেন সুন্দর, অংশগ্রহণ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জন্য যা করেছে তা যেন অব্যাহত রাখে। আর সংলাপের দরজা যাতে বন্ধ না করেন।
অন্যদিকে, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বহাল থাকায় দলটি আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। জামায়াতের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও নির্বাচনে ব্যবহার করতে পারবে না।
জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, তফসিল পেছানো বা না পেছানো সেটা আমাদের জন্য মূখ্য নয়। আমার এ সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। আমরা সরকার বিরোধী আন্দোলনে আছি। নিবন্ধন বাতিল হলেও দল হিসেবে জামায়াত তৎপর আছে। সংবিধান অনুযায়ী দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নাই। আমরা দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে না পারলেও, প্রতীক ব্যবহার করতে না পারলেও কোনো দল বা জোটের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারব। আমাদের প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচন করতে পারবেন। তবে সেটা আমরা যখন নির্বাচনে যাব তখন সিদ্ধান্ত নেব। এখন আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি না।
এদিকে, রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে তফসিল পেছলে নির্বাচনে যাবে বিএনপি। তবে দলীয় সূত্র জানায়, তফসিল ঘোষণার পরও বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। বরং রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচি জোরদারের পাশাপাশি ক‚টনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে দলটি। ক‚টনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ নেই, গুঞ্জন থাকলেও ভোটে যাবে না বিএনপি। দলের নেতাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ নিচ্ছে পুলিশ। নেতাকর্মীদের না পেয়ে স্বজনদের আটক ও মারধর করছে। তাদের গ্রেপ্তার বাণিজ্যের লাইসেন্স দিয়েছে শেখ হাসিনা। এ সরকার আবারও গায়ের জোরে তার উচ্ছিষ্টভোগীদের নিয়ে একতরফা ভোটহীন আরেকটি পাতানো নির্বাচনের তামাশা করছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোট ডাকাতি করা হয়েছিল। ভোটকেন্দ্রে ভোটার দেখা যায়নি। আর এবার চোর-ডাকাত দিয়ে ভিন্ন কোনো পন্থায় ভোটের নামে আরেকটি ভাঁওতাবাজির প্রহসন করতে মরিয়া তারা। তবে এতসব করেও এবার আর পার পাওয়া যাবে না। জনগণ রাজপথে নেমেছে অধিকার আদায়ের দুর্বার আন্দোলনে। ফরমায়েশি তফসিলে একতরফা কোনো নির্বাচন হবে না। জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, নির্বাচনে বিএনপি না এলে তা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে না। এখানে ইসি থেকে সরকারের ভ‚মিকা বেশি। বিএনপির সব দাবি মেনে নিতে হবে, আমি তা বলছি না। তবে সরকার অনেক কিছু ছাড় দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ইঙ্গিত দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে তফসিল পিছিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি ভালো নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL