আগামী বছরের জুনে পুরোদমে চালু হতে যাচ্ছে পায়রা সমুদ্রবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এতে বছরে আয় হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সেই সঙ্গে চালু হতে যাচ্ছে দুটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই দুই প্রকল্পে পাল্টে যাচ্ছে পুরো দক্ষিণাঞ্চল। বিশেষ করে এই দুই কেন্দ্রকে ঘিরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ২০ হাজার মানুষের।
এছাড়া এই দুই প্রকল্পকে ঘিরে নির্মাণ করা হচ্ছে রেলপথ, কন্টেইনার টার্মিনাল, বাল্ক টার্মিনাল, মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, মডার্ন সিটি, বিমানবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ১৯টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের কাজ এখন শেষের পথে।
দেশে আমদানি করা পণ্যের অন্তত ৩০ ভাগ পায়রা বন্দর দিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ। তাই ঢাকার সাথে রেলপথে পায়রা বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করার কাজ চলছে। এক দিকে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, অন্যদিকে পায়রা সমুদ্রবন্দর যা পাল্টে দেবে দেশের অর্থনীতি। এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রাবনাবাদ মোহনায় আন্ধারমানিক নদীর তীরে টিয়াখালীতে ১৬ একর জমির ওপর পায়রা সমুদ্রবন্দর উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকেই সীমিত পরিসরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমসহ বন্দরে বহির্নোঙ্গরে অপারেশনাল কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ফলে ১৬৯টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের অপারেশনাল কার্যক্রম সম্পন্ন করে ৩৫৪ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এখন বন্দরে চলছে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম। নির্মাণ করা হচ্ছে টার্মিনাল, ইয়ার্ড, জেটি ও কন্টেইনার টার্মিনাল।
এ বিষয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল জানান, বেলজিয়ামের একটি প্রতিষ্ঠান এই কাজ করবে। অবকাঠামো নির্মাণ শেষে আগামী বছরের জুনে পুরোদমে চালু হবে এ বন্দর। রাবনাবাদ চ্যানেলের ড্রেজিং কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হবে। পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ইপিজেড, এসইজেড, জাহাজ নির্মাণ এবং মেরামতি খাতে ব্যাপক কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। বরিশাল, পটুয়াখালী এবং ভোলাসহ দেশের অন্যান্য জেলার মানুষের একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে তেমন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গত বছর ১৬ জানুয়ারি পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং কাজের উদ্বোধন করেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল’। ফলে বাংলাদেশ এখন নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারবে।
এরপর গত বছর ১৫ মার্চ সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ তহবিল থেকে প্রথম পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও মেইনটেইনেন্স ড্রেজিং শীর্ষক স্কিমে অর্থায়ন করা হবে জানান প্রধানমন্ত্রী।
সম্প্রতি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। সভা শেষে এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা অংশ ব্যয় করা হবে পায়রা বন্দর নির্মাণে। এ প্রকল্পটি আগে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এখন সেটা দেশি অর্থায়নেই বাস্তবায়ন করা হবে।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। আগে বলেছিলাম বিদেশিরাও আমাদের সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু এখন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রকল্পটি এখন নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থে গঠিত বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল থেকে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বরিশাল, পটুয়াখালীর, বরগুনা, কুয়াকাটা, কলাপাড়া, লালুয়া, রামনাবাদসহ পায়রা বন্দর এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে দাবি করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর্থ সামাজিক অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। এদিকে, পায়রা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে গোটা পায়রা বন্দর এলাকা ঘিরে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
রামনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা আয়নাল ফকির বলেন, পায়রা বন্দর হওয়াতে এলাকার জমির মূল্য বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। এখানকার মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে চলেছে এ বন্দর। এ বন্দরে শুধু পণ্য খালাসই নয়, পণ্য খালাসকে ইতোমধ্যে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
নৌ-মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পায়রা সমুদ্রবন্দরের এই মেগা প্রকল্পটি স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি তিন ভাগে নির্মাণ করা হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদির শেষ পর্যায়ের কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। একই সঙ্গে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদির কার্যক্রমও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য মোট ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে । পায়রা বন্দরে জাহাজ নোঙর করতে মোট ১৬টি জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বড় বড় জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করার জন্য ড্রেজিংয়ের কাজ গত বছর থেকেই শুরু হয়েছে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ইতোমধ্যে রামনাবাদ নদীবন্দরকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে প্রায় এক হাজার মিটার নদীরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বন্দরে নির্বিঘ্নে রাতেও কাজ করার জন্য ৭০টি সৌরবিদ্যুৎ স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়েছে। বসানো হয়েছে সিগন্যাল বাতি। আপাতত পণ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রে নোঙর করবে। বন্দরে ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য ক্রয় করা হয়েছে দুটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর। নিরাপত্তার জন্য সেন্টি পোস্টসহ নিরাপত্তা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া কলাপাড়ার ধানখালীতে নির্মাণ করা হচ্ছে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এ ব্যাপারে সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, পায়রা সমুদ্রবন্দরের কারণে দক্ষিণাঞ্চল হবে উন্নয়নের রোল মডেল। এ বন্দর শুধু ব্যবসায়ীদের উপকার হবে না, সাধারণ মানুষের ভাগ্যেরও পরিবর্তন ঘটাবে। পায়রা বন্দর দক্ষিণাঞ্চলের ১৬টি জেলার পাল্টে দেবে গ্রামীণ অর্থনীতির দ্বার।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্নের প্রকল্প। পায়রা বন্দরকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বেগবান হবে। পায়রা বন্দরসহ বিশাল সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার জন্য পায়রা বন্দর এলাকায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি এবং ‘শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্ট’ নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। পায়রা বন্দরকে গতিশীল করতে ড্রেজিং কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। জরুরি মেইনটেনেন্স ড্রেজিং-এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে প্রতিমন্ত্রী জানান
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL