২১-নভেম্বর-২০২৪
২১-নভেম্বর-২০২৪
Logo
জাতীয়

দুর্নীতি দমনে দুদকের স্মার্ট সেল

এম এ বাবর:
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-২৭ ০০:৪২:৫৫
...

দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ গড়তে কিছু মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৪ সালের ৯ মে গঠিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছরেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত এ সংস্থাটি। যদিও সরকার ও দুদকের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমনে নানা পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলা হয়। বিভিন্ন সময় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও দুর্নীতি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্সের কথা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এরপরও দুর্নীতি থেমে নেই। কারণ বাংলাদেশে দুর্নীতি যে ব্যাপকতর ও গভীরতর হচ্ছে তার তুলনায় দুদকের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে। তবে দুর্নীতিবাজদের ধরতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে এবার তৈরি হচ্ছে দুদকের স্মার্ট টিম।

সম্প্রতি দুদকের বেশ কয়েকটি অভিযান ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। কয়েক মাস আগে রাজশাহীতে উপ-কর কমিশনারের অফিস ড্রয়ার থেকে দুদক কর্মকর্তারা যেভাবে কাড়িকাড়ি টাকা বের করেছেন সেটি দেখে অনেকই হতবাক। এরপর শরীয়তপুরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের কার্যালয়ে একই ধরনের আরেকটি অভিযান চালায় দুদক। একজন ব্যবসায়ীর অভিযোগের সূত্র ধরে বিসিক কর্মকর্তাকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষসহ হাতেনাতে ধরে দুদক। এসব ঘটনা মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে সরকারি অফিসে ঘুষের ব্যাপকতা কতটা। এই ঘুষ লেনদেন শত কিংবা কয়েক হাজার টাকার নয়। এখানে হাজার-হাজার কিংবা কখনো লাখ-লাখ টাকা ঘুষের ব্যাপার। সাধারণ মানুষ তো বটেই, দুর্নীতি নিয়ে যারা কাজ করেন তারাও দুদকের এসব অভিযান ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তারপরও দুর্নীতিবাজরা থেমে নেই।

দুর্নীতির প্রবণতা বুঝতে, ধরন শনাক্ত করতে এবং মোকাবিলায় নতুন উপায় বের করতে দুদকের নতুন স্মার্ট সেল বা ইউনিট গঠনে আগ্রহী সংস্থাটি। বিষয়টি ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপতির কাছে এ সুপারিশ তুলে ধরা হবে বলে জানা গেছে।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় চাওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়। প্রতিবেদনে আগামীর নীতি ও পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরা হবে। তবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে নেওয়া কৌশলগত নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাটাকে চ্যালেঞ্জও মনে করছে দুদক।

সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে দুদক সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কৌশলগত পরিকল্পনায় বৃহৎ পরিসরে দুর্নীতি দমনের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক প্রয়াসকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চায় তারা। যে নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায় সেগুলো হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, কার্যকর অনুসন্ধান ও তদন্ত, কার্যকর প্রসিকিউশন, কার্যকর প্রতিরোধ ও গবেষণা কার্যক্রম এবং কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা।

যদিও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে দুদক। তারপরও তারা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি কিছু কর্মপরিকল্পনা পেশ করতে চায় রাষ্ট্রপতির কাছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে যুগোপযোগী একটি নতুন অর্গানোগ্রাম প্রণয়ন, নতুন কর্মী নিয়োগ, উত্তম কাজের পুরস্কার হিসেবে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা এবং পর্যাপ্ত ও যথোপযুক্ত লজিস্টিক সাপোর্টের ব্যবস্থা করা। যদিও ২০২৩ সালে কমিশনে বিভিন্ন পদে ১২৮ জনকে নিয়োগ দিয়েছে। এরপরও কিছু অনুমোদিত পদ শূন্য রয়েছে।

মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ, মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ এবং পদক্ষেপ গ্রহণ, দুদকের ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের সক্ষমতা বাড়ানো, ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিংয়ের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করা, একটি ডেডিকেটেড প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন, অর্থবছরের শুরুতে বার্ষিক প্রশিক্ষণ কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য কোর্স (ঞঙঞ) আয়োজন এবং দুর্নীতি দূরীকরণে দুদককে সহায়তাকারী অংশীদারদের সঙ্গে মতবিনিময়।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে দুদক ও জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য দুদকের মৌলিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা বিধি প্রণয়ন করে তা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ ও নৈতিকতা বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে চায় তারা।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মৌলিক কার্যক্রমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অনুসন্ধান ও তদন্ত। এবারের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে সক্ষমতার অভাব এবং গতানুগতিক পদ্ধতির প্রয়োগ, অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে দুদকের প্রচেষ্টাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যে কারণে কার্যকর অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম নিশ্চিতে কিছু পদক্ষেপ নিতে চায় সংস্থাটি।

স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রয়োজনীয় জনবল, লজিস্টিক এবং অন্যান্য সুবিধা অন্তর্ভুক্তি এবং পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ এবং সততার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করতে চায় সংস্থাটি। মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রাসঙ্গিক আইন, বিধি, সার্কুলার এবং অফিস আদেশ অন্তর্ভুক্ত করে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি যুগোপযোগী গাইডলাইন তৈরি করে সেটা অনুসরণ করা। অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং তাদের তদারককারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা রাখা।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অনুসন্ধান, তদন্ত, বিচারিক কার্যক্রম এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য দুদক কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে চায় সংস্থাটি। এরজন্য মানসম্পন্ন ডিটেনশন সেন্টার স্থাপন এবং ডিটেনশন সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখা।

দায়ের করা দুর্নীতি মামলার বিচার ও তদারকি করা যে কোনও দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তবে এসব মামলার বিচারে কার্যকর সহায়তা দেওয়ার জন্য বর্তমান কমিশনে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও লজিস্টিক নেই। সেজন্য লজিস্টিক এবং অন্যান্য সুবিধাসহ প্রসিকিউশন ইউনিটের জন্য অর্গানোগ্রামে জনবল রেখে সেই অনুযায়ী দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রসিকিউটরদের দুদক চাকরি বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী নিয়োগ দিতে চায় দুদক। এছাড়া প্রসিকিউটর এবং তাদের তত্ত্বাবধায়কদের জন্য গাইডলাইন তৈরি করে প্রসিকিউটর এবং তত্ত্বাবধায়কের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়।

জনগণের সক্রিয় সমর্থন বা অংশগ্রহণ ছাড়া দুর্নীতিবিরোধী কোনও উদ্যোগই সফল হতে পারে না বলে মনে করে দুদক। দুর্নীতির প্রবণতা বোঝা, দুর্নীতির রূপ শনাক্ত ও মোকাবিলায় নতুন উপায় বের করে সেটার মাত্রা মূল্যায়নের জন্য গবেষণা জরুরি বলে মনে করে সংস্থাটি। তাই কমিশনের নিজস্ব গবেষণা ও উন্নয়ন ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে তুলে ধরবে দুদক, যেটা অনুসন্ধান, তদন্ত, বিচার এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রচেষ্টাগুলোর সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

দুর্নীতি দমনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুদকের সক্ষমতা বাড়াতে প্রতি বছরই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কিছু পরিকল্পনা হাতে নেয় দুদক। এবছরও নেওয়া হয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও কার্যকর করা কতটুকু সম্ভব?

জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন পুরো বিষয়টি নিয়ে এখনই বিস্তারিত বলতে চাননি। তবে তিনি বলেন, বাৎসরিক পরিকল্পনা ওই বছরই বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধে গণশুনানি, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি ও সততা স্টোরের কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সারাবছরই কাজ করা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে নানা কারণে ব্যতিক্রম হয়।