বাংলাদেশের মানুষের ওপর প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে হৃদরোগের মৃত্যু। আগে এতে বয়স্ক লোক বেশি আক্রান্ত হলেও এখন যুবক এবং শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুসারে দেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদরোগ। বিবিএস গত জানুয়ারিতে তাদের নিয়মিত প্রকাশনা বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২ (এসভিআরএস) প্রকাশ করেছে। তাতে জন্ম, মৃত্যু, গড় আয়ু, মৃত্যুহার, শিক্ষা, বেকারত্ব এই ধরনের বেশ কিছু বিষয়ে সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ের তথ্য আছে।
এসভিআরএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যানকে আমাদের আশঙ্কারই বাস্তব রূপ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তামাকের ব্যবহার, কায়িক পরিশ্রম কম করা, ওজন বৃদ্ধি, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, লবণ বেশি খাওয়া এবং বায়ুদূষণের কারণে দেশে হৃদ্রোগ ও হৃদ্রোগে মৃত্যু বাড়ছে। এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ঠিক কোন বিষয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
বিবিএসের জরিপ অনুসারে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশি মারা যায় শহরের মানুষ। ২০২১ সালের তুলনায় হার্ট অ্যাটাক থেকে মৃত্যুর সংখ্যা সামান্য কমলেও এটিকে বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো মৃত্যুর প্রধান ১৫টি করণ উল্লেখ করেছে। এই তালিকার শীর্ষে আছে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু বা হঠাৎ হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু। মোট মৃত্যুর ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশের কারণ হার্ট অ্যাটাক। অন্যদিকে তালিকার ৮ নম্বরে আছে নানা ধরনের হৃদ্রোগ। মোট মৃত্যুর ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশের পেছনে আছে এই নানা ধরনের হৃদ্রোগ।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, তামাকের ব্যবহার, ওবিসিটি বেড়ে যাওয়া, ট্রান্সফ্যাট, লবণ বেশি খাওয়া এবং বায়ুদূষণের কারণে দেশে হৃদরোগের মৃত্যু বাড়ছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেসের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ডা. অমল কুমার চৌধুরী বলেছেন, আরো বেশি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হলেও উন্নত চিকিৎসাসহ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে।
হৃদরোগ প্রতিরোধের গুরুত্ব তুলে ধরে ডা. অমল জানিয়েছেন, আগে বয়স্করা হৃদরোগ আক্রান্ত হলেও এখন তরুণেরাও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি শিশুরাও হৃদরোগ মারা যাচ্ছে। তিনি নিয়মিত হার্ট চেকআপ করার ব্যাপারে জোড় দিয়েছেন কারণ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশী। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী কোনো ধরনের যোগাযোগ করার আগেই মারা যায়। ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তীব্র ব্যথায় দুই একটি শব্দ উচ্চরণ করেই মারা যায়। আর মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যক্তি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ পায়। কারো যদি বুকে ব্যথা হয় এবং এর জন্য যদি মানসিক চাপ অনুভূত হয় অথবা কাজ করতে গেলে যদি ব্যথা বাড়ে, ঘাম হয়, বমি হয় এবং এর সাথে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাহলে অপেক্ষা না করে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। ৫ বছর পর কারো হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি আছে কিনা তা আগেই বোঝা যায় বলে জানান ডা. অমল কুমার চৌধুরী।
তিনি বলেন, ইকো ও ইটিটি টেস্ট করলে বোঝা যায় ৫ বছরের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি আছে কিনা। এই টেস্টগুলো পজিটিভ আসলে ওজন বেশী থাকলে তা কমাতে হবে, শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। তাহলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২২ অনুসারে, হার্ট অ্যাটাক দেশে ১৭.৪৫ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। এর পরেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা, ব্রেন স্ট্রোক, হাঁপানি, অন্যান্য জ্বর, লিভার ক্যান্সার, নিউমোনিয়া, হƒদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, সড়ক দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যায়।
বিবিএস জানিয়েছে, হার্ট অ্যাটাকে গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি মানুষ মারা যায়। শহরে মৃত্যুর হার ২৪.০৯ শতাংশ এবং গ্রামে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর হার ১৫ দশমিক ০৭ শতাংশ। বৃদ্ধ বয়সে হার্টের সমস্যার কারণে ২৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ মানুষ মারা যায়। এছাড়া বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর অন্যান্য প্রধান কারণ হল: ফুসফুসের রোগ (১২ দশমিক ২৬ শতাংশ), হাঁপানি (৬ দশমিক ৯০ শতাংশ) এবং ব্রেন স্ট্রোক (১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ)।
হার্ট অ্যাটাক এবং হৃদরোগে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার ২.৮৩ শতাংশ যেখানে গ্রামের (২ দমমিক ৬৮ শতাংশ) তুলনায় শহরে (৩ দশমিক ৫০ শতাংশ) মৃত্যুর হার বেশী।
বিবিএসের পরিসংখ্যান হৃদরোগের পাশাপাশি স্ট্রোক, কিডনি এবং লিভারের রোগ বৃদ্ধিকেও নির্দেশ করে। এটি হৃদরোগসহ সমস্ত অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা বাড়ানোর বিষয়টি তুলে ধরে।
ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৬৭ শতাংশ ঘটে অসংক্রামক রোগের (এনসিডি) জন্য। এর মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ (৩০ শতাংশ)। ২০২৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এনসিডিজ: এসডিজি লক্ষ্যের দিকে যাত্রা" শিরোনামের একটি সমীক্ষায় দেখানো হয়, ২০২১ সালে ডবিউএইচও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে সমস্ত মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশর জন্য দায়ী এনসিডি রোগগুলো।
এনসিডি রোগের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুর হার বেশি। তারপরে ক্যান্সার, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ এবং ডায়াবেটিস মৃত্যুর অন্যতম কারণ। ভারতেও গত তিন বছরে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্ভবত কোভিড-১৯ মহামারির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কারণে এমনটি ঘটছে।
DP-MA
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL