পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য যোগাযোগে নতুন দিনের সূচনা হলো। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ীর লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরি পারাপারের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিল। যদিও সরকার এ রুটের ফেরিগুলোকে দেশের অন্যান্য এলাকায় যুক্ত করবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নৌরুটের লঞ্চ ও স্পিডবোটের মালিক-শ্রমিকরা। তারা এখন নতুন রুটের সন্ধান করছেন বলে জানা গেছে।
ফেরি মানেই ঘাটে ভোগান্তি, ধীরগতির নদী পারাপার, ঘন কুয়াশা, ঝড় ও দুর্যোগে যাত্রা বাতিল এবং বেশি স্রোত অথবা নদীর নাব্যসংকটে ফেরি অচল। ঈদ কিংবা বড় কোনো ছুটিতে ভোগান্তি বাড়ে কয়েকগুণ। তাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের এ ভোগান্তি নিরসনে সরকার ২০১১ সাল থেকে পদ্মার বুকে সেতু করার কাজ হাতে নেয়। কিন্তু নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতার কারণে শুরুতেই হোচট খায় এ প্রকল্প। এরপর ২০১৫ সালে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি তদারকিতে বাস্তবায়ন শেষে অবশেষে রোববার (২৬ জুন) এটি সবার জন্য খুলে দেয়া হয়।
যদিও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতে একে একে সেতু হয়েছে। মানুষের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। পণ্য পরিবহন গতি পেয়েছে। বড় বাধা ছিল পদ্মা পারাপার। এই নদী পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলায় যাতায়াতে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো মানুষকে, পণ্যবাহী ট্রাককে। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর এটি দিয়ে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের প্রধান ১০টি মহাসড়কের ৯টিই ফেরি পারাপারের ভোগান্তিমুক্ত হয় (ঢাকা থেকে পাটুরিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত বাদে)।
এদিকে শিমুলিয়া ঘাটে ১৫১টি স্পিডবোট ও ৮৭টি লঞ্চ চলাচল করে। এ রুটের নৌযানে মালিক ও শ্রমিক সব মিলিয়ে জীবিকা নির্বাহে এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। যদিও পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাজিরকান্দি নৌরুটে চলাচলকারী লঞ্চ ও স্পিডবোটের চালক, মালিক কর্মচারীরা খুশি। তবে উদ্বোধনের দুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা আর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সেতু চালু হওয়ায় নৌরুটে আর কোনো যাত্রী আসবে না। এতে নৌযান বন্ধ হয়ে পড়লে বহু বছরের জীবিকার কী হবে? মাথার ওপর এখন দুশ্চিন্তার মেঘ প্রমত্ত পদ্মায় যাত্রী পারাপারকারী এসব মানুষের। পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহে তারা এখন নতুন নৌরুট খুঁজছেন। এ জন্য তারা সরকারি সহযোগিতার দাবি করেন। তবে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
স্পিডবোট মালিক তপু আহমেদ জানান, পদ্মা সেতু চালু হয়েছে খুশি কিন্তু আমাদের কী হবে? রোববার শুধু একটা ট্রিপ নিয়েছি। আজকে (গতকাল) সোমবার একটাও পাই নাই। স্পিডবোট চললে আমি আর আমার চালকরা দুইটা টাকা পাব। এখন যা চায় তা দিয়েই স্পিডবোট বিক্রি করে ফেলতে হবে। আট লাখ টাকা খরচ করে স্পিডবোট কিনছিলাম। এখন তো কেনার মতো মানুষই পাই না। মাঝখানে একজন ৫ লাখ টাকায় নিতে চেয়েছিল, দিলাম না। বিক্রি করা ভালো ছিল। কিস্তি নিয়ে স্পিডবোটটা কিনেছিলাম। এখন প্রতি মাসে কিস্তি টানতে হয় ৮ হাজার ১৬০ টাকা। আয় নাই, কিস্তির টাকা দিব কীভাবে জানি না। তবে এখন নতুন কোনো কাজের সন্ধান করছেন বলে জানান তিনি।
স্পিডবোট চালক বেলাল হোসেন বলেন, আমার দুটি স্পিডবোট। একটি আমার নিজের, আরেকটি চার বন্ধু মিলে কিনেছি। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় হতো। শিমুলিয়া ঘাটে সিরিয়াল অনুযায়ী স্পিডবোট চলে। যাত্রী কম থাকায় কালকে সিরিয়াল পাইনি। আজকে পাব কি না সন্দেহ। স্পিডবোট আয়ের একটি অংশ চালকরা পায়। স্পিডবোট না চললে চালকরা কই থেকে টাকা পাবে। ঘাটে অনেকেই স্পিডবোট বিক্রি করে ফেলেছে, আবার সিলেটের জন্য ভাড়া দিচ্ছে। আমি যা পাই তাই দিয়েই আমারটা বিক্রি করে অন্যকোন ব্যবসা শুরু করতে চাই।
এমএল তপন লঞ্চের মালিক খোকন আহমেদ জানান, পদ্মা সেতু চালু হয়েছে আমরা খুশি। আশপাশের ঘাট এলাকার লোকজনও খুশি। দীর্ঘদিন ধরে লঞ্চটা চলছে। শিমুলিয়া নৌরুটে ভালোই ছিলাম। লঞ্চের সাতজন কর্মচারী, তারাও ভালো ছিল। এখন পদ্মা সেতু চালু হয়েছে মাত্র দুই দিন। এর মধ্যেই যাত্রী নাই। ঘাট থেকে কাল মাত্র দশটার মতো লঞ্চ ছেড়ে গেছে। আজ অনেকটাই ফাঁকা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন- বিকল্প নতুন রুট তৈরি করে এই লঞ্চকে সেই রুটে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয় যেন।
এমএল ফাহিম-তামিম লঞ্চের মাস্টার জাহাঙ্গীর জানান, গতকাল একটা ট্রিপ ছিল। আজ তো যাত্রীই নাই। বসে আছি, সিরিয়াল পাব কি না জানি না। মালিক জানে কী করব। লঞ্চ বিক্রি করব না কি অন্য লাইনে চালাবে। তবে আমাদের একটা কথা আছে। আমরা যারা লঞ্চের স্টাফ বা লঞ্চচালক তাদের লাইসেন্সে মাওয়া জোন লেখা। সরকারের কাছে আবেদন, এটা যদি সরিয়ে দেয় তাহলে আমরা অন্য জায়গায় লঞ্চ চালাতে পারি।
শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার মোহাম্মদ হাবিব জানান, আগে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৮০ থেকে ১০০টি স্পিডবোট ট্রিপ পাওয়া যেত। আজকে (সোমবার) সকাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র দুটা স্পিডবোট ছেড়ে গেছে ঘাট থেকে। তাহলে বোঝেন স্পিডবোটের এ পেশায় থাকা কতটা মুশকিল।
তিনি আরও বলেন, এক বছরের জন্য গত জুন মাসে আড়াই কোটি টাকার ইজারা পাই বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ থেকে। বছর শেষ হয়নি, এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেল। তাই সরকারের কাছে আবেদন আমাদের দিকে তাকায় কিছু ক্ষতিপূরণ যেন দেওয়া হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (লৌহজং) আব্দুল আওয়াল বলেন, শুধু লঞ্চ চালক শ্রমিক বা স্পিডবোট চালক শ্রমিকই না। শিমুলিয়া ঘাটকেন্দ্রিক জীবিকার সঙ্গে জড়িত, এমন পাঁচ হাজার জনের নাম আমাদের ডেটাবেজে আছে। পদ্মা সেতু পুরোপুরি চালু হতে আরও ছয় মাস লেগে যাবে। আমরা যতটুকু জেনেছি ভারি যানবাহন নিচ দিয়ে চলাচল করবে। পদ্মা সেতু কেন্দ্রিক পর্যটন বাড়লে এসব লঞ্চ এবং স্পিডবোট ব্যবহূত হতে পারে। সেক্ষেত্রে তা কর্মসংস্থানের যোগান দিবে।
শিমুলিয়া নদীবন্দরের সহকারী বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, নৌযান ও সংশ্লিষ্টদের পুনর্বাসনে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চলছে বিকল্প অভ্যন্তরীণ নৌরুট খোঁজার কাজ। পাশাপাশি যাত্রী চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিমুলিয়া নদীবন্দরেও থাকবে ব্যবস্থা। বিআইডব্লিউটিএ’র নৌবন্দরের যেসব স্থাপনা রয়েছে যেমন চিলমারী বাহাদুর শাহ এবং ঢাকার অদূরে যেখানে লঞ্চ চলাচল করতে পারে সেসব জায়গায় লঞ্চ চলাচলের জন্য শিমুলিয়া লঞ্চ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শিমুলিয়া লঞ্চ মালিক সমিতির লোকজনসহ আমরা বেশ কয়েক মাস আগেই বিভিন্ন নৌবন্দরে ঘুরে এসেছি এবং লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করছি।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL