প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ আমাদের জীবনকে করছে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। কিন্তু সেই সঙ্গে এই প্রযুক্তিই আমাদের নতুন প্রজšে§র জন্য হয়ে উঠেছে দুর্ভাগ্যের কারণ। এক সময় মোবাইল ফোন শুধু ব্যবহার করা হতো কথা বলার জন্য। কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির কল্যাণে সে মেবাইল ফোন এখন স্মার্ট হয়ে গেছে।
কয়েক বছর আগেও খেলা বলতে গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, লাটিম, মার্বেল, ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু, দৌড় এসব ছিল। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারে সেসব খেলাধুলার এখন শুধুই স্মৃতি। দেখা যায়, বাসা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট কিংবা পার্কে গিয়েও অনেক শিশু মোবাইল নিয়ে বসে আছে। আশেপাশে কী হচ্ছে, সেটা জানার আগ্রহ নেই তাদের। যে কিশোরটি খেলাধুলা আর বই পড়ায় ব্যস্ত ছিল, বিশেষ করে গল্পের বই পড়ত; মুঠোফোন ব্যবহার শিখে সে এখন ডুবে গেছে নানা ধরনের গেমে। আর বই পড়ে না, মা-বাবার সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না, সারা দিন মুখ গুঁজে থাকে মুঠোফোনে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ধ্বংসাত্মক ভিডিও গেমসে বুঁদ হয়ে থাকার ফলে বিশ্বব্যাপী শিশুরা এমন নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে, যা থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যে বয়সে বাবা-মায়ের মুখে বিভিন্ন গল্প শোনে সময় কাটানো কথা, সে বয়সে আমরা তাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছি কার্টুন সহ বিভিন্ন সিরিয়াল দেখতে দিয়ে। কার্টুন তো শিশুর অবশ্যই ভালো লাগার বিষয়। আর সেলফোন, ট্যাবলেট, টেলিভিশন ও কম্পিউটারের মত ডিভাইসগুলোও শিশুরা সব সময়ই উপভোগ করে। কিন্তু সেটারও একটা বয়স আছে, সময় আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোরদের মধ্যে যারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে ফেসবুকে লগইন করে তাদের প্রবল রাগ, মানসিক বিপর্যয়, আক্রমণাত্মক, অসামাজিক আচরণ ও অস্পষ্টতা বেড়ে যায়। গবেষণায় আরো দেখা যায়, যারা নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং ভিডিও গেমস খেলে তারা বেশি উদ্বেগ এবং হতাশা প্রদর্শন করে। এটি মস্তিষ্কের নির্বাহী কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এই এক্সিকিউটিভ ফাংশন যেমন- পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার দেওয়া, সংগঠিত করা, এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও অন্তর্ভুক্ত। ফ্রন্টাল লোব হলো মস্তিষ্কের ক্ষেত্র, যা আমাদের নির্বাহী কার্য এবং জ্ঞানীয় দক্ষতা নিয়ন্ত্রণ করে। ইলেকট্রনিক্সের অত্যধিক ব্যবহারে ধূসর পদার্থ, ক্ষয় বা টিস্যু ভলিউমের ক্ষতি হতে পারে। ধূসর পদার্থ মেমরি, পেশি নিয়ন্ত্রণ, আবেগ, বক্তৃতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্ব-নিয়ন্ত্রণ, এবং দৃষ্টিভঙ্গি এবং শোনার মত কাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্বের মতো অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনই কর্মব্যস্ত। উভয়েই ছুটছেন ক্যারিয়ার ও সফলতার পেছনে। এদিকে সন্তান বড় হচ্ছে প্রায় একা একা। অনেক সময় মায়েরা শিশুকে খাবার খাওয়াতে, কান্না থামাতে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও ভিডিও গেমসের অভ্যাস করাচ্ছেন। কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের এই সহজ সুযোগে এর প্রতি আসক্তি বেড়েই চলছে। গেমসের কারণে মারমুখী ক্ষ্যাপাটে আচরণ, বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, অল্পতেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়া, ইন্টারনেট না থাকলে অথবা মোবাইল বা কম্পিউটারের চার্জ ফুরিয়ে গেলে অস্থির-আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার ঘটনা তো অহরহই ঘটছে।
বিশ্বব্যাপী গেমসের প্রতি তীব্র নেশা যে পাবজি গেম থেকে শুরু হয়েছে, তা নয়। ইতিপূর্বে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান, মনস্টার হান্টার ওয়ার্ল্ড, ডটা টু, ভাইস সিটি এবং হাঙ্গারসহ নাম না-জানা অসংখ্য গেমে মানুষের ভীষণ আসক্তি ছিল। অতিরিক্ত গেম খেলায় বাবার বকুনি খেয়ে অভিমানী তাইওয়ানি কিশোরের নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, একটানা ২৪ ঘণ্টার লাইভ ভিডিও গেম খেলতে খেলতে ২২ ঘণ্টার মাথায় যুবকের মৃত্যুবরণ, অনলাইন ভিডিও গেমের জন্য টাকা জোগাড় করতে ১৩ বছরের ভিয়েতনামি কিশোরের ৮১ বছরের বৃদ্ধাকে রাস্তায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তার মানিব্যাগ চুরি এবং লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা, চায়না দম্পতির কম্পিউটার গেমের অর্থের জন্য নিজেদের তিন সন্তানকে ৯ হাজার ডলারে বেচে দেয়াÍ এরূপ হূদয়বিদারক গেম আসক্তির ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর ঘটেছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস-ঘটিত এ আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল মাদক’। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভিডিও গেমসের প্রতি তীব্র আসক্তিকে বিশেষ এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ অসুখের নাম দেয়া হয়েছে ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ বা ‘গেমিং রোগ’। সংস্থার খসড়া একটি নথিতে ভিডিও গেমে আসক্তিকে একটি আচরণগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে। এ আচরণে আসক্তির সব লক্ষণ রয়েছে।
উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রিটেন, জার্মানি এবং চীনে ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত হবার জন্য আলাদা চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে এ ধরনের আসক্তদের মানসিক রোগীর মতোই চিকিৎসা দেয়া হয়। থেরাপিসহ বিভিন্ন চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক-সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের আসক্ত মানুষের সংখ্যা সব দেশেই বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্যমতে, দেশের ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সি প্রায় ৬০ লাখ শিশু-কিশোর ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে নানা জটিলতায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারে এখন শিশুদের খেলনার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে মোবাইল ফোন; অবুঝ শিশুদের জন্য খেলনা মোবাইল আর বুঝমান শিশুদের জন্য অ্যানড্রয়েট মোবাইল। শিশুর বায়না পূরণে মোবাইলে গেমস দেখা বা গান শোনা যেন এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে মোবাইল ফোনের বিকিরণের কারণে শিশুর চোখে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একটি শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম। ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে। বাংলাদেশেও ইন্টারনেট প্রসারের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী, যাতে রয়েছে শিশুরাও। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এইচ এম সাইদুর রহমান বলেন, আমাদের জীবনে ডিভাইস আসক্তি আধুনিক প্রযুক্তির খুবই ইনফ্লুয়েন্স রয়েছে। এর পরিধি ও তীব্রতা মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে বেশি। শিশুরা খেলাধুলা করতে পারছে না। কারণ শহরে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। অপরদিকে আমাদের জীবনের ব্যস্ততা ও ধৈর্যের সীমা কমে যাওয়ায় শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছে না পরিবার। ফলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার কোয়ালিটি টাইম ব্যয় করা খুবই জরুরি। আমাদের এখনই সচেতন হয়ে সবার মধ্যে সাড়া জাগাতে হবে। ডিভাইসের সঠিক ব্যাবহার করার কথাও মাথায় রাখতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রিস্টার্ট মেন্টাল হেলথ সার্ভিসের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর-সিইও মো. ওয়াহিদ আনোয়ার রনো এ প্রতিবেদককে বলেন, যেসব বাচ্চা ডেভেলপমেন্টাল, মেন্টাল ডিজঅর্ডার, অটিজম, বিহেবিয়ার থেরাপিসহ নানা সমস্যা নিয়ে আসে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ডিভাইসে আসক্ত। তাদের বয়স সাধারণত চার থেকে শুরু। এরা অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে চায় না; খাবারে থাকে অরুচি। একা একা সময় কাটাতে পছন্দ করে; একইসঙ্গে ডিভাইসকেন্দ্রিক জগৎ তৈরি হয় তাদের। দেখা যায় খুব অল্প বয়সেই তারা পর্নোগ্রাফিতেও আসক্ত হয়ে পড়ে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে ৮০ শতাংশ শিশু ডিভাইস আসক্ত এবং তাদের অবাস্তব চাহিদাও প্রচুর। ডিভাইসগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার একটি শিশুর সামাজিক দক্ষতা উন্নয়নে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, কাজের দায়িত্ব নেওয়া, ভালো আচরণ প্রদর্শন করা, মার্জিত ভাষা ব্যবহার, আবেগ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ, মৌখিক নির্দেশনা অনুসরণ এবং অন্যদের জন্য সহানুভূতি গড়ে তোলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও একটি শিশু সামাজিক সংকেতে কম মনোযোগী ও কম শনাক্ত করতে পারে। শিশুর ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারে বেশি সময় ব্যয় করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। শুধু তাই নয় এটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করতে পারে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL