দেশের কৃষি অর্থনীতির দ্রুত অগ্রসরমান খাত হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থানে রয়েছে প্রাণিসম্পদ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য স্বাধীনতার পরে এই খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে। বেশ কয়েকবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাগাদা দেওয়ার পরেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পূর্ণাঙ্গ জরিপ চালায়নি। দিতে পারেনি দেশের উদীয়মান এই খাতের পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চলমান প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) মাধ্যমে বিবিএস-দেশের ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলায় হাউসহোল্ড লাইভস্টক ডিজিটাল সার্ভের কাজ শুরু করছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করার জন্য দেশব্যাপী শুরু হয়েছে প্রাণিসম্পদের জরিপ। এ কাজে সহায়তা করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এটি ২০ জানুয়ারি শুরু হলেও চলবে চার মার্চ পর্যন্ত। তিনি আশা করেন, এ জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এই সেক্টরের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা। জানা যাবে, দেশে প্রাণিসম্পদের প্রকৃত চিত্রও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় স্বাধীনতার পর দেশের বিকাশমান এই প্রাণিসম্পদ নিয়ে পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয়নি। ফলে ধারণার ওপর ভিত্তি করে খাতভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে সরকারে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও বিবিএস দেশব্যাপী পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ প্রাণিসম্পদ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও প্রাণিসম্পদ নিয়ে একটি পৃথক ও একক জরিপের বিষয়টি উঠে আসে। দেশব্যাপী গবাদি পশুর দেশি ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পরিসংখ্যান থাকা প্রয়োজন। এবিষয়ক সঠিক পরিসংখ্যান থাকলে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাও সহজ হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ শুমারিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি প্রস্তাব বিবিএসে পাঠায়। এভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের থেকেও পত্রের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিবিএসে চিঠি পাঠানো হয়েছিল।
বিবিএস সূত্র জানায়, কৃষিশুমারি পরিচালনার সময় কৃষক, কৃষিজমি, অস্থায়ী শস্য, স্থায়ী শস্য, কৃষি শ্রমিক, প্রাণিসম্পদসহ সব বিষয়ই শুমারির তথ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকত। তবে ২০১৮ সালের কৃষিশুমারিতে প্রাণিসম্পদের জন্য আলাদা তথ্য সন্নিবেশন করা হয়েছি। কিন্তু প্রাণিসম্পদ নিয়ে পৃথক জরিপ চালাতে গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এবং এ ধরনের একটি বিশেষায়িত জরিপের জন্য লোকবল প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এসব দিক বিবেচনা করে শুধু প্রাণিসম্পদ নিয়ে একক জরিপ পরিচালনা করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিবিএস কৃষিশুমারির সঙ্গে আংশিকভাবে প্রাণিসম্পদ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সম্প্রসারণ কার্যক্রমের আওতায় মাঠ পর্যায়ের সীমিত জনবল দিয়েই এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। পরিসংখ্যান আইন-২০১৩-এর ধারা ৬ (গ) মোতাবেক জনশুমারি, কৃষিশুমারিসহ অন্যান্য শুমারি ও জরিপের লক্ষ্যে যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়টি বিবিএসের আওতাধীন। এ হিসাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদবিষয়ক জরিপের দায়িত্বও সংস্থাটির ওপরই ন্যস্ত।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ কোঅর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, দেশে গবেষণা ও প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য একটি সার্ভের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল ও আর্থিক সংস্থান না থাকার কারণে আগে এটি করা সম্ভব হয়নি। এখন বিশ্বব্যাংকের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা এলডিডিপি ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে এই জরিপ কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে বিবিএস। প্রকল্পভুক্ত এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে এলডিডিপির প্রতিনিধি ডাবেন। এবং প্রয়োজনীয় তথ্য করে ডিজিটালি সংগ্রহ করবেন। যা জমা হবে বিবিএস এর সার্ভোরে। মেট্রোপলিটন এলাকাবাদে প্রাথমিকভাবে সকল উপজেলার তথ্য সংগ্রহ করা হবে। পরে মেট্রোপলিটন এলাকায় জরিপ চালানো হবে। তবে মার্চ মাস জুড়েই তথ্য সংগ্রহ চলবে। তারপর শুরু হবে ডাটা পর্যালোচনা। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মে মাসে পাওয়া যাবে বলেও আশা করেন তিনি। এর পুরো সার্ভে পরিচালনায় ৭-৮ কোটি টাকা খরচ হবে বলেও জানান গোলাম রব্বানী।
তিনি আরো বলেন, এ জরিপের ফলে দেশে বর্তমান প্রাণিজ (হাস, মুরগি, মহিষ, গরু, দুগ্ধবতী গাভী ও মহিষ, দুধের উৎপাদন, ডিম উৎপাদন, দেশে ঘাস চাষসহ প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হবে) সম্পদের অবস্থা। প্রাণীভিত্তিক আলাদা ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য ওঠে আসবে।
প্রকল্পভুক্ত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় সার্ভে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে পরবর্তীতে অধিদপ্তরের মাধ্যমে জরিপ করা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপাতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণিসম্পদের বিচ্ছিন্নভাবে জরিপ হলেও দেশব্যাপী কোনো জরিপ ছিল না। দেশের ৬১ জেলায় সরকারে এর উদ্যোগ প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
বিবিএস সূত্র জানায়, পৃথকভাবে প্রাণিসম্পদ শুমারি বা একক জরিপ কার্যক্রম কখনো পরিচালিত হয়নি। তবে প্রতি ১০ বছর অন্তর কৃষিশুমারির সঙ্গে আংশিকভাবে প্রাণিসম্পদ জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বাংলাদেশে কৃষিশুমারি হয়েছিল ২০০৮ সালে। ১০ বছর পর ২০১৯ সালে একটি কৃষিশুমারির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কৃষিশুমারির সময় অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরি করে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এককভাবে পশুসম্পদ নিয়ে জরিপ বা শুমারি না হলেও কৃষিশুমারির সঙ্গে কৃষি, পশু সম্পদ ও মৎস্যসম্পদ নিয়ে পৃথক একটি ডাটা তৈরি করা হয়।’ ২০১৯ সালে কৃষিশুমারির পর ২০২০ সালে পুনরায় নতুন কিছু প্রশ্নমালা তৈরির মাধ্যমে প্রাণী ও মৎস্যসম্পদ নিয়ে পৃথক তথ্যসংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL