২২-নভেম্বর-২০২৪
২২-নভেম্বর-২০২৪
Logo
জাতীয়

বেজার পরিবর্তন আনাই চ্যালেঞ্জ

এম এ বাবর
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-০৯ ১৪:৪৫:০৫
...

প্রতিষ্ঠার একযুগেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। উদ্যাক্তাদের অনাগ্রহ, প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান না পাওয়ায় ধুকছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে নেয়া ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েও বিপাকে পড়েছে সংস্থাটি। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে দেশের শিল্প খাতে পরিবর্তন আনাই চ্যালেঞ্জ বেজা’র।

শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর এলাকা, সম্ভাবনাময় সকল এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতেই বেজা’র সৃষ্টি। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ আইন-২০১০ অধ্যাদেশ দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বেজা’র প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রতিবছর ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করা। কিন্তু ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে গত এক যুগে কাক্সিক্ষত লখ্যে পৌঁছাতে পারেনি বেজা। ফলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বেজা’র আওতায় এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান ও ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কি-না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

এদিকে বেজা’র আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। এতেই আর্থিক হিসাবে দেখা দিয়েছে বড় ঘাটতি। বর্তমানে সংস্থাটির ঘাড়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা চেপে বসেছে। বর্তমানে বেজা’র ১১টি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু আছে যার ৮টি বেসরকারি খাতের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। কাক্সিক্ষত আয় না থাকায় গত কয়েক বছর ধরে নেওয়া ঋণের কিস্তির টাকার অভাবে পড়ে সংস্থাটি গত বছরের নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ঋণ পরিশোধে পুনঃতফসিলের সুবিধার অনুরোধ করেছিল।

দেশজুড়ে পরিকল্পিত ১০০টি শিল্প অঞ্চলের মধ্যে ৩০ হাজার একরের বিশাল অর্থনৈতিক এলাকা ঘিরে তৈরি সবচেয়ে বড় মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের অনীহা বেজা’র আর্থিক সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই ধাক্কা বেজা’র আয় সৃষ্টি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সংস্থাটির নেওয়া ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করেছে। বেজা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, বেজা’র সামনে বর্তমানে ৩টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে : প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান, জমি পাওয়া এবং প্লট নেওয়ার পরও বরাদ্দকৃত প্লটে বিনিয়োগ না করা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া। যেমন, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে ৫০০ একর জমি বরাদ্দ নিলেও এখনো সেখানে কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি। এমন আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা জায়গা নিলেও এখনও ফ্যাক্টরি তৈরি করেনি।

বেজা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ২০২১ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর স্থাপনে বিশ্বব্যাংক থেকে চার হাজার ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয় বেজা। পরের বছর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে জাইকা থেকে দুই হাজার ১২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সংস্থাটি। বাকি ঋণ দিয়েছে অর্থ বিভাগ ও সরকারি অর্থায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল)। এসব পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি। বেজা’র নথি অনুযায়ী, এতদিন সরকার বেজাকে ১ শতাংশ সুদে ঋণ দিত। কিন্তু সর্বশেষ ঋণে তা হয়েছে ৬ শতাংশ।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের আয়ের উৎস মাত্র দুটি। ভূমি ইজারা দেওয়ার বিপরীতে আয় এবং পরিষেবা দেওয়ার বিপরীতে সার্ভিস চার্জ ও ইউটিলিটি বিলের ওপর সারচার্জ। তারা বলছেন, ব্যয়ের তুলনায় আয় খুবই অপ্রতুল। শিল্প কারখানা পুরোদমে চালু না হওয়ায় পরিষেবার বিপরীতেও আয় কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেজা বিভিন্ন খাত থেকে মোট প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় করেছে। সংস্থাটি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগকারীদের ১২৫ ধরনের সেবা দেয়।

বেজা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, তারা ২০১৫ সালের অর্থ বিভাগের একটি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি। অন্যান্য স্থানীয় ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করা হচ্ছে। এছাড়া বিদেশি সংস্থার ঋণের গ্যারান্টার সরকার। এসব ঋণ সরকারি পর্যায়ে পরিশোধ হবে। যদিও অর্থ বিভাগের কাছে কত টাকা বকেয়া তা জানাননি তিনি। তবে বেজা’র আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ২০২৩ সালের জুনের হিসাব পর্যন্ত ঋণের কিস্তি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বর্তমানে বেজা’র কাছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু এই টাকা থেকে ঋণের কিস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের অনেক কাজ এ অর্থে করতে হচ্ছে।

সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কীভাবে ঋণ পরিশোধ করা হবে সে বিষয়ে বেজা একটি পর্যালোচনা করেছে এবং এই পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। বেজা সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি নিজেদের কার্যক্রমের ব্যয়কে সরকারি অনুদান হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে যেসব ক্ষেত্রে অনুদান দেওয়ার সুযোগ নেই, সেসব ক্ষেত্রে কম সুদের ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করারও প্রস্তাব করেছে এটি। এছাড়া ফায়ার স্টেশন ও সংযোগ সড়ক তৈরি, রেললাইন গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার মতো কার্যক্রম সরকারি স্ব-স্ব সংস্থা যাতে করে দেয় সেই প্রস্তাব করেছে বেজা।
এদিকে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা বেজা’র প্রস্তাব পর্যালোচনা করছেন। পাশাপাশি বেজাকে আয় বাড়ানোর জন্য সেবামূল্য বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, আগামীতে বেজা’র প্রকল্পগুলো আংশিক অনুদান ও আংশিক ঋণ ব্যবস্থায় অর্থায়ন করা হতে পারে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঋণ নেওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। তবে প্রশ্ন হলো ঋণ নেওয়ার সম্ভাব্যতা কীভাবে যাচাই করা হয়েছিল তা। তিনি বলেন, বেজা আশা করেছিল অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ আসবে এবং সেখান থেকে যে আয় হবে, তা থেকে ঋণ পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে আয়ও হচ্ছে না। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এবং বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মডেল হিসেবে দু-একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করে দ্রুত সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেন তিনি।

অন্যদিকে, সরকারি-বেসরকারি মিলে এ পর্যন্ত ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ১১টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৪১টি শিল্পকারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ৫৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর বাইরে আরও ৫০টি শিল্প-কারখানার অবকাঠামো নির্মাণাধীন রয়েছে। পাশাপাশি আরও ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ চলছে। বেজা এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য সারাদেশে ৬২ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে।

এখন পর্যন্ত ১৯৭ বিনিয়োগকারীর অনুকূলে ছয় হাজার ৬০৭ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ২৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়েছে যার মধ্যে দেড় বিলিয়ন ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে যেসব দেশ উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে তার মধ্যে রয়েছে জাপান, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও নরওয়ে।
যেসব ব্র্যান্ড বিনিয়োগ করেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এশিয়ান পেইন্টস, বার্জার পেইন্টস, জতুন পেইন্ট, আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেড, সুমিটোমো করপোরেশন, সিসিইসিসি, জেই হং, ইয়াবাং গ্রুপ, ম্যারিকো, নিপ্পন স্টিল, হোন্ডা মোটরস, মিয়াগো, হ্যান্টসম্যান, সিগওয়ার্ক, ও সাকাত ইংক। অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পাশাপাশি বেজা মহেশখালী ও টেকনাফে ৩টি (সোনাদিয়া, সাবরাং ও নাফ) ট্যুরিজম পার্ক স্থাপন করেছে। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে ইতোমধ্যে ২১টি কোম্পানিকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।