যানজটের নগরী ঢাকায় আশা জাগানিয়া মেট্রোরেলের যাত্রীরা এখন আর এই বাহনটিতে ভরসা পাচ্ছে না। এক বছর আগে দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধন হলেও এর পূর্ণ সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত নগরবাসী। হুটহাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চলাচলের দ্রুততম এই বাহনটি।
কখনো যান্ত্রিক জটিলতা, কখনো ঘুড়ি, কখনও ফানুস, কখনও বা বিদ্যুৎ- নানা কারণে থেমে যাচ্ছে মেট্রোরেলের চাকা। আবার যাত্রীদের এমআরটি পাসও নষ্ট হচ্ছে হুটহাট। সকালে চারটি ট্রেন চলার পর সাময়িকভাবে ট্রেন চলাচলে দেরি হচ্ছে। শিডিউল মতো চলছে না আধুনিক এ যানটি। আর তাতেই ভরসার মেট্রোরেল মাঝে মাঝেই হয়ে উঠেছে অনিশ্চয়তার কারণ। যে কারণে মেট্রোরেল নিয়ে মানুষের মধ্যে উল্লাস ছিল, নানা কারণে প্রায়ই মেট্রোরেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু মেট্রোরেলে। ঘটা করে উদ্বোধনের পর গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে জনসাধারণের জন্য খুলেছে মেট্রোরেলের দুয়ার। প্রথম দিকে আগারগাঁও থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ী পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে ছুটলেও আগামী ২৬ মার্চ থেকে মেট্রোরেল থামবে মাঝের স্টেশনগুলোতেও। তবে নানা ভোগান্তির মধ্যে মেট্রোরেলে যাতায়াতে এমআরটি পাস পেতে ভোগান্তির অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। নির্ধারিত সময়েও কাউন্টারগুলো চালু না করা, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখাসহ নানা অভিযোগ সেবা গ্রহীতাদের। আবার রীতিমতো যুদ্ধ করেও ট্রেনে উঠতে পারছেন না যাত্রীরা। যাত্রীদের চাপের ফলে ট্রেনের দরজা বন্ধ করতেও ৮ থেকে ১০ মিনিট কেটে যায়।
এ ছাড়া প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ত্রুটির কারণে কিছু কিছু সময় বন্ধ থাকে মেট্রোরেল। যদিও মেট্রোরেল চলাচলের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি সাবস্টেশনে দুটি ট্রান্সফরমার রয়েছে। একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং অন্যটি জরুরি প্রয়োজনে চালু হবে। অর্থাৎ কোথাও বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ হবে না। তারপরও প্রায় প্রতি সপ্তাহে টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে বন্ধ থাকছে মেট্রোরেল।
দৈনিক ১৩ ঘণ্টার বেশি সময় চলাচল করছে আধুনিক এই বাহনটি। কম সময়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কারণে মেট্রোরেল জয় করেছে নগরবাসীর আস্থা। তবে সাম্প্রতিক জটিলতাগুলো ভাবাচ্ছে জরুরি সময়ে হঠাৎ আটকে পড়া নিয়ে।
পূর্বঘোষণা ছাড়াই চলতে চলতে হঠাৎ বন্ধ হচ্ছে মেট্রোরেল। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ নানা সময়ে নানা কারণ দেখাচ্ছে। কখনও অল্প সময়ে ঠিক হয়ে যাবার কথা বললেও ঘণ্টাখানেকও বিলম্ব হচ্ছে। ফলে যাত্রীরা যে সময়ের পরিকল্পনা নিয়ে মেট্রোরেল এসেছিলেন বা কাজের পরিকল্পনা করেছিলেন, তা অনিশ্চয়তার কবলে পড়ছে।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা অভিযোগ করছেন, মেট্রোরেল জাপান তৈরি করলেও পরিচালনাও টেকনিক্যাল কাজে নিয়োজিত হয়েছে ভারতীয় কিছু টেকনেশিয়ান। ফলে মেট্রোরেলের ঘন ঘন ত্রুটি দেখা দেয়া নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। সম্পূর্ণরূপে চালু হওয়া মেট্রোরেল এই চার মাসে কতবার বন্ধ হলো তার সঠিক হিসেব নেই।
আবার কেউ বলছেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে উত্তরা-মতিঝিল বাস রুটে যাত্রীদের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এই রুটে বাস যাত্রী কমে যাওয়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন বাস মালিকরা। সে কারণে বাস মালিকদের সাথে আঁতাত করে পরিকল্পিতভাবে মেট্রোরেল সার্ভিসে বিঘ্ন ঘটানোর কাজ করছে কোন চক্র।
গত ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে মেট্রোরেলের বিভিন্ন অংশে চলাচলের বিদ্যুতিক তারে আটকা পড়ে উড়ে আসা ফানুস। এতে কয়েক ঘণ্টা এটি চলাচলের জন্য বন্ধ থাকে। সকালে যাতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কর্মীরা রাত ৩টা থেকে মেট্রোরেলের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে আটকে থাকা ফানুস সরিয়ে ফেলেন, এর পরে চালু হয় এ বাহনটি। এরপর গত ২৪ জানুয়ারি মেট্রোরেলের ক্যাবল ছিঁড়ে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ কয়েক ঘণ্টা। সবশেষ গত শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকালেও জটিলতায় পড়ে মেট্রোরেল। দরজা বন্ধ না হওয়ার জটিলতায় প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে চলাচল।
শামীম আহমেদ নামের মিরপুরের এক যাত্রী বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এ নিয়ে। মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর অনেকের মতোই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি। তবে ৬ মাসে অন্তত ৭ দিন তিনি যান্ত্রিক জটিলতায় পড়েছেন। কখনো অপেক্ষার পর মেট্রোরেলে চড়েই বিলম্বে অফিসে পৌঁছেছেন। আবার কখনো বা অন্য বাহনে গিয়েছেন।
এমআরটি পাস নিতে আসা সামছুল আরেফিন নামে এক কার্ড প্রত্যাশী অভিযোগ করেন, চারটি কাউন্টারে কার্ড দেওয়ার সুযোগ থাকার পরও একটা বন্ধ রেখেছে। আবার একটা চালু করা হলেও কিছুক্ষণ পর সেটিও বিকল হয়ে পড়েছে। ঘোষণা দিয়েছেন সকাল থেকে কার্ড পাওয়া যাবে, কিন্তু দিচ্ছে বিকেলে। সামান্য একটা ফর্ম প্রিন্ট দিতে কম্পিউটার দোকানিরা নিচ্ছেন ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
যদিও এসব অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট উপ প্রকল্প পরিচালক (লাইন-৬ অতিরিক্ত গণসংযোগ কর্মকর্তা) নাজমুর ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, এখনও সবগুলো সিস্টেম আপডেট হচ্ছে। মেট্রোরেল আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা, সমস্যায় পড়ার পর থেকে তা সমাধানে কাজ চলমান।
তাসলিমা আলম চাকরি করেন কাওরান বাজারের একটি প্রতিষ্ঠানে। গত দুই মাস ধরে তিনি নিয়মিত মেট্রোরেলেই যাতায়াত করেন। তার দাবি, গত দুই মাসে তিন দিন অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে পারেননি তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মেট্রোরেল আমাদের আস্থার প্রতীক। সঠিক সময়ে নিরাপদে পৌঁছাতে পারব বলেই মেট্রোতে যাতায়াত করি। এখন সেটিও সময়সূচি মেনে চলে না। হঠাৎ করেই যান্ত্রিক জটিলতায় বিলম্ব হচ্ছে। আবার ঘুড়ি বা ফানুসের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মেট্রোরেলের আরেক নিয়মিত যাত্রী চৈতন্য চন্দ্র হালদার বলেন, বৃহস্পতিবার আমি সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে মতিঝিলের দিকে যাওয়ার জন্য মিরপুর-১০ স্টেশনে ছিলাম। ট্রেন এসেছিল ৮টা ১৩ মিনিটে। ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে অনেক যাত্রী জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন।
এর আগেও এরকম হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি গত একমাসে এরকম তিন বার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। হয় সময়সূচিতে জটিলতা হচ্ছে, অথবা বাহনই আটকে যাচ্ছে। ট্রেন বিলম্বে আসার কারণে অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থীকেও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।
মেট্রোরেলের সময়সূচির জটিলতার পাশাপাশি এমআরটি পাসের জটিলতাও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ বলছেন, তিন দিন ধরে ঘুরছি, সার্ভার বন্ধ থাকায় কোনো সমাধান পাচ্ছি না। কেউ বলছেন, এমআরটি পাসে তো হয়রানি আরও বেড়ে গেছে। আবার কেউ কেউ পুরো সিস্টেমকে দোষ দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির অধীনে আনতে বলছেন। আবার কেউ বলছেন, এমআরটি পাসে ম্যাগনেটিক রিবন আছে। কার্ডটি যত্ন করে রাখতে হবে।
সম্প্রতি ফেসবুকে মেট্রোরেলের একটি কমিউনিটি গ্রুপে তানজিনা আমান তানজুম ও জিন্নুন নাহার নামের দুজন মেট্রোরেলের যাত্রী দ্রুত এমআরটি পাস ড্যামেজ হওয়া নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। তারা সার্ভার সমস্যার কারণে হয়রানির ভোগান্তিতে পড়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন।
তানজিনা আমান লিখেছেন, সুস্থ কার্ড হুটহাট ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে! কার্ড নিয়ে গেলেই বলে এর কাছে যান, ওর কাছে যান! এমআরটি পাসে হয়রানি তো আরও বেড়ে গেল! তার ওপর কার্ডে বেশি রিচার্জ করে নিলাম তখন বলে ড্যামেজ।
জিন্নুন নাহার লিখেছেন, ২০২২ সালে দিল্লিতে ছিলাম। এক বছরে কখনো কার্ড ড্যামেজ, সার্ভার নাই এসব শোনা লাগেনি। তখনের চেয়ে প্রযুক্তি এখন আরও এগিয়েছে! আরও অনেক ফার্স্ট কাজ করার কথা। প্রতীতি চৌধুরী নামের একজন লিখেছেন, কার্ড দেখতে ঠিকঠাক হলেও ভেতরে চিপ আছে সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে ড্যামেজ। এক্ষেত্রে আপনার দোষ নেই। যিনি কাউন্টারে দায়িত্বরত তাদেরও দোষ নেই। কারণ সার্ভারে সমস্যা থাকলে আপনার তথ্য শো করবে না, ফলে এটা রেজিস্ট্রেশন করে পুনরায় আপনাকে নতুন কার্ড দেওয়ার সুযোগ নেই।
গণ পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলেন, মেট্রোরেল সারা বিশ্বেই অতি ঘন ঘন চলাচলকারী গণপরিবহন। এর জন্য সর্বদা তৎপর, স্মার্ট ও দক্ষ জনবল দরকার। কিন্তু আমাদের মেট্রোরেলে প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটছে এবং ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা, যা দুঃখজনক। মানুষ তার চলাচলের সময়ে মেট্রোরেলের মতো একটি সময়সাশ্রয়ী, ভোগান্তিহীন বাহন পেলে তাতেই উঠবে। দরকার ব্যস্ত সময়ে চলাচল বাড়ানো এবং সবাই যাতে উঠতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা। ঘনঘন যান্ত্রিক ত্রুটি হলে যাত্রী ভোগান্তি বাড়বে এবং মানুষ মেট্রোরেলের চলাচলে আগ্রহ হারাবে। তাই এ প্রতিষ্ঠানটি বাঁচাতে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করা পরামর্শে দেন তিনি।
মেট্রোরেলের এসব সমস্যা নিয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নাজমুল ইসলাম ভূইয়া জানান, বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের কথা বলার পরামর্শ দেন। তার দাবি, এ ধরনের বিষয়ে কথা বলার অনুমতি তার নেই। বিষয়টি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পর্যায়ের তাই পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। তবে মোবাইল ফোনে চেষ্টা করা হলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিকির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, ডিএমটিসিএলের আরেকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সঙ্গে কথা বলেছেন। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি বলেন, মেট্রোরেলে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে পুরো ব্যবস্থা বন্ধ করে এর কারণ খুঁজতে হয়। এরপর ত্রুটি চিহ্নিত করে সমাধান করার পর পুনরায় চালু করলেই মেট্রোরেল চলা শুরু করে না। পুরো ব্যবস্থাটি পুনরায় চালু হতে সময় লাগে। তবে আশা করছি দ্রুত এসব জটিলতা কেটে যাবে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL