সংকট, সংকট আর সংকট। সার্বিক সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে জনগণ। সাধারণ মানুষ এখন যাবে কোথায়। নিকট অতীতে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সরকারকে বলত, তুমি গরিবের জন্য কী করছ? পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, এখন সরকার যেন প্রশ্নটা উল্টে দিয়ে বলছে, তুমিই বা কী করছ? সাধারণ মানুষের উপরে এ এক রকম উল্টো চাপ। অর্থনীতি বলে, ধনী-গরিব আপেক্ষিক ধারণা, তাই তুমি কি ধনী? প্রশ্ন করলে পাল্টা-প্রশ্ন মনে আসে, ‘কার চাইতে ধনী?’
দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত কীভাবে বেঁচে আছে তা ভুক্তভোগীই জানেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরে কমার পর সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি আবারও চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেড়ে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ০২ শতাংশে উঠেছিল, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। প্রতিযোগিতামূলক সমন্বিত বিদ্যুতের বাজার তৈরি কওে, ভর্তুকি না দিয়েও জনগণকে কম খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন তারা। তবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকারের পরিকল্পিত বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিম্ন-আয়ের গ্রাহকদের ওপর প্রভাব ফেলবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভর্তুকি কমানোর জন্য আগামী মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে শুধু দাম বাড়ানোর ওপর নির্ভর করলে বিদ্যুৎ খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর টেকসই সমাধান করা যাবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ চুক্তি বাতিল করে প্রতিযোগিতামূলক সমন্বিত বিদ্যুতের বাজার তৈরি করা উচিত।
আইএমএফের ঋণের শর্তপূরণে আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ২০ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৪ শতাংশ বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দেন। সর্বশেষ এক বছর আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মহাপরিচালক (পাওয়ার সেল) মোহাম্মদ হোসেন বলেন, দুই ধাপে বিদ্যুতের দাম ৪-৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পাওে, একবার রমজানের, আরেকবার ঈদের পরে। এই পদক্ষেপে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি ১৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।
বিপিডিবির তথ্যানুসারে, ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নিলে বিদ্যুতের দাম ৭৮-৮১ শতাংশ বাড়তে পারে। তাই সংস্থাটি ধীরে ধীরে দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে, যাতে জনসাধারণের অতিরিক্ত বোঝা না হয়ে যায়। ফলে চলতি বছর একাধিক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সরকার যদি বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল না করে শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, তাহলে তা টেকসই সমাধান দেবে না। বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ চুক্তি বাতিল করে এবং প্রতিযোগিতামূলক সমন্বিত বিদ্যুতের বাজার তৈরি করে সরকার ভর্তুকি না দিয়েও জনগণকে কম খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও একই মত দিয়েছেন। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু কমিশনিং হওয়ার পর সেটি বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক বা না করুক, ওই কেন্দ্রকে চার্জ দিতে হয় সরকারের, সেটিই ক্যাপাসিটি চার্জ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে সূত্রমতে, ২০২২-২৩ সালে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ৪৩ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ভর্তুকিবরাদ্দ করেছিল, যার বড় একটি অংশ ব্যয় হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে। বিপিডিবির তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ সালে ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য প্রায় ১৭ হাজার ১৫৫ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে গত বছর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, গত ১৪ বছরে ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিশেষ করে ক্যাপাসিটি চার্জ-সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনার কারণে সরকার বিদ্যুতে ভর্তুকিদিতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার ১৭-১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার জায়গায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎতের ক্যাপাসিটি তৈরি করে ফেলেছে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি করে ফেলেছে, যার ফলে অনেক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে বিশাল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে সরকার। আগামী ১-২ বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াট হবে, তখন আরও বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
ইজাজ হোসেন আরও বলেন, সরকার আইএমএফের কথামতো বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, অথচ আইএমএফের কথামতো ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম কমাচ্ছে না। ডিজেলের বর্তমান দাম আন্তর্জাতিক দামের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারের এ ধরনের দ্বৈত নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন-আয়ের মানুষ।
তবে নসরুল হামিস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, মার্চ থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে দেশেও ওঠা-নামা করবে জ্বালানি তেলের দাম। সরকারের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার সমালোচনা করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অযৌক্তিক ও অপব্যয় রোধে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা সাধারণ মানুষের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলবে। এর কারণ হলো বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল সব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্যের দামও বাড়বে। শেষ পর্যন্ত এর বোঝা বহন করতে হবে মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত সাধারণ মানুষকে।'
তবে নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিম্ন-আয়ের গ্রাহকদের ওপর প্রভাব ফেলবে না। আমরা এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেব, যাতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করা গ্রাহকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে আবাসিকের পাশাপাশি দেশের শিল্প খাতগুলোতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
নিট পোশাক প্রস্তুতকারক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ার কারণে উৎপাদন এমনিতেই অর্ধেকে নেমে এসেছে। শিপমেন্ট শিডিউল ফেইল করার কারণে ক্রেতাদের অনেকে এয়ার শিপমেন্টের জন্য চাপ দিচ্ছে, কেউ ডিসকাউন্ট দাবি করছে। কোনো কোনো ক্রেতা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিলের কথা বলে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়লে সেটার বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে উৎপাদনে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য সাধারণত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) গণশুনানির আয়োজন করতে হয়, তারপরে সমন্বয় প্রচেষ্টা চালাতে হয়। তবে সম্প্রতি আইনের সংশোধনের কারণে সরকার এখন এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গিয়ে দ্রুত মূল্য সমন্বয়ের জন্য ‘নির্বাহী আদেশ’ জারি করতে পারে।
সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০২৩ সালের মার্চে। ওই মাসে ৫ শতাংশ সমন্বয় করা হয়েছিল বিদ্যুতের দাম। এর পর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের ভারিত গড় দাম ৮ দশমিক ২৪ টাকা হয়েছে। বিপিডিবির একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিদ্যুতের বর্তমান গড় খুচরা মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৫ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৬ দশমিক ৭০ টাকা। ভর্তুকি পুরোপুরি উঠিয়ে দিতে সরকার বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ১২ দশমিক ১১ টাকায় করার লক্ষ্য নিয়েছে। এই সমন্বয়ের ফলে ভোক্তা পর্যায় বিদ্যুতের দাম বেড়ে হবে ১৪ দশমিক ৬৮ টাকা।
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি যত বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, তার সমস্ত বিদ্যুৎ এবং আমদানির অংশ একক ক্রেতা হিসেবে কিনে নেয় বিপিডিবি। সংস্থাটি কেনা দামের চেয়ে কম দামে সেই বিদ্যুৎ বিক্রি করে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে। বাকি টাকা ভর্তুকি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।
তবে চলমান ডলার সংকট ও যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হচ্ছে না বলে অর্থ বিভাগ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকা যথাসময়ে দিতে পারছে না। বিপিডিবির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ভারতের আদানি গ্রুপ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ও শেভরনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। বিপিডিবির তথ্য অনুসারে, গত ১৪ বছরে ১২ দফা মূল্যবৃদ্ধিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম অন্তত ১২১ শতাংশ বেড়েছে।
২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ দশমিক ৭৩ টাকা। গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট। প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ২৫ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ১১ দশমিক ৩৩ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ৮ দশমিক ৮৪ টাকা।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL