এবারের ঈদুল আজহাতেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমেনি। গত শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৩৭ জনের। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেই। পাশাপাশি লাইসেন্সবিহীন চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে লাইসেন্স দেওয়ারও প্রক্রিয়ায়ও বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালকরাই বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। বেশকিছু দুর্ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া চালকদের ছিল না লাইসেন্স। বর্তমানে দেশে অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। নতুন চালক তৈরির প্রকল্প আলোর মুখ না দেখায় কাটছে না চালক সংকট। কবে ওই প্রকল্পের কাজে গতি আসবে তাও সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশে ৪৬ লাখ যানবাহনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অবৈধ চালক রেখে সড়ক কোনো অবস্থাতেই নিরাপদ করা সম্ভব হবে না। সেজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে চালকের পেশাকে মর্যাদার স্থানে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে এ পেশায় শিক্ষিত তরুণসহ নারীদের নিয়ে আসতে হবে। বাড়াতে হবে সুযোগ-সুবিধা। কার্যকর করতে হবে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের ১১১ দফা সুপারিশও বাস্তবায়নও জরুরি। প্রায় দুই বছর আগে টাস্কফোর্স সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১১১ দফা সুপারিশের পর কয়েকটি বৈঠক হলেও তা নিয়ে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, দেশের সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদার ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পর্যায়ক্রমে ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার। সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদার ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে করা সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত চারটি কমিটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। আর প্রদত্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সবাই তাদের সুচিন্তিত মতামতও দিয়েছে। তবে তাতে একটু সময় লাগবে।
সূত্র জানায়, নিচসার হিসাবে করোনা মহামারির মধ্যে দুই মাসের বেশি সময় সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সড়কে প্রায় ৫ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে গত বছর সড়কে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
নিসচার দাবি, দীর্ঘদিন পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকার থাকার পরও মৃত্যুর যে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তাতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে তা বলার সুযোগ নেই। এক বছরের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী নিহতদের মধ্যে ২৫ ভাগ চালক ও পরিবহন শ্রমিক। সারাদেশে দুর্ঘটনার শিকার ৫১ হাজার ৬৬৮টি বাসের মধ্যে ৬৯৮টি বাস। ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ মিলে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪৭৭টি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তাছাড়া পুরো বছরে এক হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার আগের বছরের চেয়ে মৃত্যু ৮ ভাগ বেড়ে ২৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে। তারপরই পুরো বছরে মুখোমুখি সংঘর্ষ, উল্টে গিয়ে এবং গাড়িচাপায় দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গাড়িচাপায় নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ৯০, মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬৯৮ ও উল্টে গিয়ে ৫৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনায় পথচারী মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ৪৬ জন, যা মোট দুর্ঘটনার ২১ ভাগ। গত বছরের জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি ৪৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৪৯৫ জন। আর দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু সবচেয়ে বেশি।
সূত্র আরো জানায়, লার্নার লাইসেন্স ফরমের শর্ত অনুযায়ী বিআরটিএ নিবন্ধিত ট্রেনিং সেন্টার থেকে শিক্ষানবিস চালকদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা। বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। আর সেটা দেখারও কেউ নেই। বেশিরভাগ চালক ওস্তাদদের কাছ থেকে ট্রেনিং নেয়। সেজন্য তারা গাড়ি চালাতে সাইন-সিগন্যালসহ রাস্তার ভাষা শিখতে পারে না। নতুন সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী যাদের হালকা তাদের মিডিয়াম, যাদের মিডিয়াম রয়েছে তাদের ভারী লাইসেন্স দেওয়ার কথা ছিল। ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা গেলে ভারী যানবাহনের চালক বাড়তো। একই সঙ্গে সড়ক নিরাপত্তাও বাড়তো। তাছাড়া হেভি লাইসেন্স দেওয়ার আগে সরকার নির্ধারিত ট্রেনিং সেন্টারে অন্তত ১৫ দিন চালকদের প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ৫ লাখ দক্ষ চালক তৈরির পরিকল্পনাও কার্যকর হয়নি। ওই পরিকল্পনা কার্যকর করা হলে দেশে দক্ষ চালক সংকট অনেকটাই কমে আসতো। পাশাপাশি মহাসড়কে অনুমোদনহীন যানবাহন উচ্ছেদ নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ অদক্ষ চালকই
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। মোদ্দা কথা- দক্ষ চালক তৈরি করতে না পারায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা করা, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বাড়ানো, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল, রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট এবং অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়ন না হওয়াই বিপুল সংখ্যক দুর্ঘটনার মূল কারণ। গত বছর বড় বড় শহর ও হাইওয়েতে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া অবৈধ যানবাহন যেমন-ভ্যান, রিকশা, নসিমন, অটোরিকশা ইত্যাদিও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। গতবছর বাস-ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ২৬ ভাগ। সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, সরকারের পক্ষ থেকে চালক তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য বহুবার বিআরটিএ, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ বিআরটিসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। অনেক চিঠি চালাচালির পর সরকারের পক্ষ থেকে ৩ লাখ চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার মধ্যে একটি বড় অংশকে ভারী লাইসেন্স দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার আগে নতুন চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হলেও করোনার জন্য এখন পুরো প্রকল্পের কাজ বন্ধ।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে নিসচা চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০টি। তার বাইরে অনিবন্ধিত নসিমন, করিমন, ভটভটি, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোসহ কয়েক লাখ যানবাহন দিব্যি চলাচল করছে। সারাদেশে ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক পরিবহন খাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ অদক্ষ চালক বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানসহ ভারী যানবাহন চালাচ্ছে। আর মোটরসাইকেলের চালকদের অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) সিতাংশু শেখর বিশ্বাস জানান, চালক বাড়াতে সরকারিভাবে বিআরটিসিকে নিয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ২ লাখেরও বেশি দক্ষ চালক তৈরি হবে। ভারী যানবাহনসহ সকল প্রকার যানবাহন থেকে চালক বেশি থাকার কথা। কিন্তু চালকের পেশায় সাধারণ মানুষ আসতে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা না পাওয়া ও সামাজিক মর্যাদা না বাড়ায় অনেকে চালক হিসেবে পেশা বেছে নিতে চায় না। তাছাড়া অনেক পরিবহন মালিক চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের নিয়মিত বেতনও দিতে চায় না। শ্রম আইন থেকে শুরু করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী চালক নিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এ পেশায় আসতে হয়তো অনেকেই উৎসাহ বোধ করবে। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর বাস্তবায়ন জরুরি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত ৬ দফা নির্দেশনামা দ্রুত বাস্তবায়ন করা, টাস্কফোর্স দাখিল করা ১১১টি সুপারিশনামা যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL