আমাদের সন্তানরা প্রবাসী শ্রমিক হয়ে, পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মূল্যবান রেমিট্যান্স আনেন দেশে। কিন্তু তাদের কষ্ট উপার্জিত রেমিট্যান্স বিভিন্ন উপায়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার বন্ধে নেই সরকারের কোনো কঠোর পদক্ষেপ। ফলে পাচারকারীরা ও লুটেরারা দেশের অর্থনীতি ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে।
অর্থপাচার রোধে দেশে সর্বমোট আটটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এতগুলো প্রতিষ্ঠান আসলে কী করছে, কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছে, তা নিয়েও যেন সরকারের মাথাব্যথা নেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ পাচার চক্রের কবলে পড়ে ২০২৪ বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে।
মাস্টারকার্ড ইকোনমিক ইনস্টিটিউট বলছে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে হবে পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ (৬.৩%)। ভারতের পরেই থাকবে তার অবস্থান। এডিবির পূর্বাভাস, জিডিপি হবে ৬ দশমিক ৫। কিন্তু অর্থ পাচার রোধে কঠোর আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশে অর্থের অবৈধ ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনটির নাম ছিল মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২ (২০০২ সালের ৭ নম্বর আইন)। এ আইনের বিধানাবলি অপর্যাপ্ত থাকায় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করে (অধ্যাদেশ নম্বর ১২, ২০০৮) কিছু বিষয় যুক্ত করে। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অধ্যাদেশটি সংবিধানের অনুশাসন অনুযায়ী পরীক্ষা করে ২০০৯ সালে আইনে রূপান্তরিত করে। আইনটির শিরোনাম ছিল মানি লন্ডারিং আইন-২০০৯ (২০০৯ সালের ৮ নম্বর আইন)। ২০০৯ সালের আইনটিও পরে বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০১২ জারি করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ নামেই পরিচিত।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে।
অর্থ পাচার বন্ধের দায়দায়িত্বের বিষয় উঠলে প্রথমেই আসে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নাম। এটি বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট নামেও পরিচিত। এরপর সরকারের অপরাধ প্রতিরোধকারী সংস্থা তথা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কাছে তা পাঠিয়ে থাকে। অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা এসব সংস্থারই। এসব সংস্থায় অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থার কথা শোনা গেলেও বড় ব্যবসায়ীদের অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করার বিষয়টি বেশ বিরল।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দেশ থেকে প্রতি বছর ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য জানায়। পাচার হওয়া এসব অর্থ চলে যায় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। এ অর্থ ফেরাতে এর আগে প্রণোদনাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এবার পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে বিশেষ স্কিম নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এতে সেসব টাকা ফেরত আসবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট মহল। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট না হওয়ায় দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরানোর বিশেষ স্কিমেও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলছেন, স্বাধীনতার পরের অর্থবছর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ছে। সমিতির হিসাবে ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাচার হওয়া অর্থের ৫ শতাংশ উদ্ধার করা গেলেও সরকার ৫৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা পাবে।
অন্যদিকে আমদানি-রফতানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালেও অর্থপাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। এমনটাই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচার মনিটরিং সংস্থা- বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। পাচারকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় পাচারকারী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সাড়ে ১৭ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে বলে দাবি আন্তর্জাতিক সংস্থাটির।
বিশেজ্ঞদের নানা মত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কারীরা আকৃষ্ট না হওয়ায় বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের কৌঁসুলিরা বলছেন, সংসদ সদস্য, বড় ব্যাংকার থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা পাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের কারণে এই অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
শুধু এক বছরের পাচার হওয়া অর্থ দিয়েই তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব উল্লেখ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, দেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে। তাই টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। তিনি জানান, ২টি প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে আছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)।
দুর্নীতিও টাকা পাচারের অন্যতম কারণ মন্তব্য করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হওয়ায় টাকা পাচার বেড়েছে। দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। তাছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, যে কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। আবার অনেকেই এ দেশে টাকা রাখতে নিরাপদ মনে করেন না। ফলে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। তার মতে, যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রতি বছরই অর্থ পাচার বাড়ছে মন্তব্য করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ থেকে প্রতি বছর যে টাকা পাচার হয়, প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনগুলো তার আংশিক চিত্র। তার মতে, যারা অর্থ পাচার করছে তারা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে অনেক প্রভাবশালী। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, দুঃখজনক বিষয় হলো পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন-কানুন অনেক আধুনিক। এরপর কেন বাংলাদেশ এই সুবিধা নিয়ে টাকা ফিরিয়ে আনতে পারছে না, তা বুঝে আসছে না। তবে সঠিক পন্থা অবলম্বন না করায় সরকার অর্থ পাচার ঠেকাতে পারছে না। একইভাবে সঠিক পন্থায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরতও আনতে পারছে বলে তিনি মনে করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কৌঁসুলি খুরশিদ আলম বলেন, কাগজে কলমে ব্যাংকিং খাত এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি আছে। কিন্তু সেই নজরদারি যথেষ্টভাবে সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করছে না। টাকা পাচারের মাধ্যমে পুরো দেশকে আর্থিকভাবে অচল করে দেওয়া হচ্ছে, পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। যারা টাকা পাচার করছে তাদের কয়েকজনকে যদি উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে সবাই টাকা পাচার করতে ভয় পাবে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL