দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিপুল পরিমাণ দেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। একদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি; অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করার তাগিদ থেকে বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। তারপরও চলতি বছর প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে গ্যাস ও কয়লার জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। বোরো ধান চাষের জন্য সেচ, রমজান মাস এবং গ্রীষ্মের গরম এবার বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যোক্তা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন বর্তমান বাস্তবতায় এ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া সর্বশেষ হিসাবে, দেশে উৎপাদনরত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৫০ কোটি ডলারের মতো (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা)। জ্বালানি তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা)। আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবিষয়ে বলেন, বকেয়া শোধ করার জন্য আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন উৎস্য থেকে কিছু ডলারের জোগান আসছে। বাকিটা অর্থ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে। সরকার বন্ড দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া কিছুটা পরিশোধের ব্যবস্থা করা হবে। বন্ডের কাজটা ধীরগতিতে হচ্ছে। ১২ হাজার কোটির মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে। বাকিটাও দ্রুত করা দরকার। এরপরও বকেয়া থাকবে পাওনার অর্ধেক।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার বিদ্যুতের দাম আমরা জ্বালানির দামের সঙ্গে বিদ্যুতের দামের সমন্বয় করছি, যা অন্য প্রতিটি দেশ নিয়মিত করে। জ্বালানি খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় গত বছর ভর্তুকির হার বেড়েছে। এ বছর ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে বিদ্যুতের জন্য প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা এবং গ্যাসের জন্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। সরকার বিদ্যুৎ খাত থেকে ধীরে ধীরে ভর্তুকি তুলে নিতে মূল্য সমন্বয় করছে।
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ফয়সাল করিম খান বলেন, বকেয়ার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। টাকা পাওয়া না গেলে আইপিপিগুলো তাদের উৎপাদন কার্যক্রম ঠিক রাখতে পারছে না। অন্যদিকে আইপিপিগুলো যেসব সরবরাহকারীর কাছ থেকে জ্বালানি কিনছে তাদের অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না। বকেয়া বাড়তে থাকলে জ্বালানি সরবরাহকারীদের আস্থা কমতে থাকে। তারা দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি করতে আগ্রহী হয় না। জ্বালানি সরবরাহে তারা গড়িমসিও করে। বকেয়া দিতে দেরি হলে চুক্তি অনুযায়ী জরিমানাও দিতে হয়। ব্যাংকগুলো নতুন আমদানির ঋণপত্র খোলার ফি বাড়িয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু হয়েছে (মার্চ) গরমের মৌসুম। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হবে, আমদানি বাড়াতে হবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল। টাকার অভাব ও ডলারসংকটের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। জ্বালানির অভাবেই গত বছর গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন অনুযায়ী চালানো সম্ভব হয়নি। এতে ঢাকায় দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা এবং গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, সরকার বিদ্যুৎ বিক্রি করে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে। বাকি টাকা ভর্তুকি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। তবে যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হচ্ছে না বলে অর্থ বিভাগ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকা যথাসময়ে দিতে পারছে না। এ বকেয়া বাড়তে থাকলে অস্থার সংকট দেখা দেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয় বলে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে, যা নিয়ে নাখোশ অর্থ বিভাগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে কেন্দ্রভাড়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিদেশি কোম্পানির দেনা পরিশোধে ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী মার্কিন ডলার দিতে পারছে না। দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি হয়। সব বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। সংস্থাটির সর্বশেষ গত মাস ডিসেম্বরের হিসাবে, তাদের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা পাবে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থ বিভাগ ভর্তুকিবাবদ যথেষ্ট টাকা না দেওয়ায় এই বকেয়া জমেছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইমরান করিম আরো বলেন, বন্ডের কাজটা ধীরগতিতে হচ্ছে। ১২ হাজার কোটির মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে। বাকিটাও দ্রুত করা দরকার। এরপরও বকেয়া থাকবে পাওনার অর্ধেক। এবারের গ্রীষ্ম মৌসুম দীর্ঘ হতে পারে। পাওনা পরিশোধ করা না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো কঠিন হবে।
সিপিডির গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল, কয়লা আমদানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনে কত ডলার লাগতে পারে, তা বছর শুরুর আগেই জানিয়েছিল পিডিবি। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে তাদের চাহিদা ছিল ৩৭৩ কোটি ডলার। আগামী ছয় মাসে চাহিদা আরও বেশি হবে। তবে নিয়মিত ডলার পাচ্ছে না পিডিবি। এতে আমদানি করা বিদ্যুতের দাম নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি।
বিপিসি সূত্র জানায়, বিদেশি কোম্পানির বকেয়া বিল জমেছে ২৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাঝে-মধ্যে দুই কোটি ডলার করে ছাড় করা হয়। তবে তা দিয়ে বকেয়া পুরোটা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিদেশি কোম্পানিগুলো বকেয়া না পেলে জ্বালানি তেল সরবরাহ না করার বিষয়ে সতর্ক করছে। দেশে উত্তোলন করে শেভরন তার ভাগের গ্যাস সরকারের কাছেই বিক্রি করে। সরকার তাদের মূল্য পরিশোধ করে ডলারে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করে শেভরন। প্রতি মাসে তাদের গড়ে প্রায় পাঁচ কোটি ডলার বিল পরিশোধ করতে হয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা এবং বিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সক্ষমতা ও বিপুল কেন্দ্রভাড়া দেশের অর্থনীতিকেই চাপে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জ্বালানি খাতেই বছরে ১২ বিলিয়ন (১ হাজার ২০০ কোটি) ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। এত ডলার জোগান দেওয়া কঠিন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘বিপিডিবির রাজস্ব আয় ঠিক থাকলেও ভর্তুকির অর্থ ছাড়ের বিলম্বের কারণে বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির অর্থ সরকার অন্যান্য খাতের আয় থেকে দিয়ে থাকে। কিন্তু আয়ের যে লক্ষ্য ধরা হয়েছিল, সেসব খাত থেকেও পযাপ্ত অর্থ আসছে না। ফলে সরকারের হাতে নগদ অর্থের সংকট রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতে বকেয়ার চক্র থেকে বের হতে হলে সময়মতো বিপিডিবির ভর্তুকির অর্থ ছাড় নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আইপিপিগুলোর সঙ্গে বিপিডিবির ডলার রেট-সংক্রান্ত জটিলতাগুলোও দূর করতে হবে। নতুবা এ চক্র থেকে শিগগিরই বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই।’
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হলো ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। এ বছর গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হতে পারে বলে ধারণা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২৫ হাজার ৪৯১ মেগাওয়াট।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৭৮টি। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার ৭৭৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে তেল ভিত্তিক ৪৭টি কেন্দ্রের ক্ষমতা ৫ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর জানাচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তেল আমদানি করা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বিপিসির কাছ থেকে কিনতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আদানির বিদ্যুৎসহ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এখাতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জ্বালানি খরচ হয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে একটা বড় অংশই তেল ও কয়লা বিদ্যুতের জ্বালানি খরচ। গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার জন্য খরচ পড়েছে ১২ হাজার ৭শ কোটি টাকার বেশি। এ বছর গরমের দিনে ৫ হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে বিদ্যুৎ বিভাগের। এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রতি দিন প্রায় ৫০ হাজার টন কয়লা।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এবার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে সাড়ে সতের হাজার মেগাওয়াট। পুরো জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে করতে হবে লোডশেডিং। এখনো গ্যাসের অভাবে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়ার জন্য ব্যয় বাড়ছে পিডিবির। বিদ্যুৎ বিভাগ যেভাবে পরিকল্পনা করছে তাতে এ বছর ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে গরমে ৫শ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হতে পারে।
পিডিবি ও পিজিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ১৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ১০০টিতে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট হলেও সেগুলোতে উৎপাদন হচ্ছে ৫ হাজার ৮৪৬ মেগাওয়াট। ফার্নেস অয়েল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট হলেও সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বেসরকারি ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ২৮৬ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে, যা গড়ে প্রায় ১ হাজার ১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট।
/মামুন
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL