এম এ বাবর
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক করতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নির্বাচনে নিশ্চিত করতে হবে। তাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার কৌশল হিসেবে প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে রয়েছে। শেষ বিচারে সেটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদেরকে সাহায্য করবে বলে আশা করছে দলটি। তবে স্বতন্ত্র এসব প্রার্থীদের নিয়ে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে।
বিএনপি ও আরো কিছু বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে থাকায় নতুন কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এবার এক আসনে নিজেদের একাধিক প্রার্থী রাখার সুযোগ রেখেছে ক্ষমতাসীন দলটি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন মনোনয়নবঞ্চিত সংসদ সদস্যরাও। একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন এমন অন্তত ৭২ জন নেতা এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় জায়গা পাননি। তাদের অনেকে যেমন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোটে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তেমনি এলাকায় যারা নিজেদেরকে জনপ্রিয় বলে মনে করছেন, তারাও ভোটে দাঁড়াচ্ছেন।
তবে কৌশলটা ভোটের লড়াইয়ে কতটা সুফল দিতে পারে তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এদিকে নির্বাচনের মাঠে একই দলের একাধিক প্রার্থীর উপস্থিতি বিশৃঙ্খলা এবং দলীয় কোন্দল বাড়াতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। যদিও আওয়ামী লীগ মনে করছে, সংঘাতের আশঙ্কা নয়, বরং এরকম একটি বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনের একটি নতুন মডেল তৈরি করেছে।
গত ১৫ নভেম্বর আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদদের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। ভোট অনুষ্ঠিত হবে ৭ জানুয়ারি। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। জোটের সঙ্গে সমন্বয় হলে কোন কোন আসন ছাড়া হবে তা অবশ্য দলের পক্ষ থেকে এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। তবে জাসদের ইনুর আসন এবং জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমানের আসন গতকাল পর্যন্ত ফাঁকা রাখা হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র জমার শেষ তারিখ আজ ৩০ নভেম্বর।
বিগত দুটি নির্বাচনে প্রায় একচেটিয়া বিজয় লাভ করলেও দেশে-বিদেশে সমালোচনা হওয়ায় নির্বাচনগুলো নিয়ে বেশ অস্বস্তি আছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দলটির মনোনীত প্রার্থীরা। এবার বহিঃবিশ্বে সরকারের প্রধান মিত্র ভারতও আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। নির্বাচনে যেন কোন রকম কারচুপি করা না হয় সে ব্যাপারে ভারতের অবস্থান খুব স্পষ্ট। তাহলে কিভাবে এই নির্বাচন হবে, যেখানে বিরোধীদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। আবার নির্বাচনও হতে হবে উৎসবমূখর ও অংশগ্রহণমূলক।
অর্থাৎ অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নির্বাচনে নিশ্চিত করতে হবে। এরকম একটি বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীর (ডামি) নামে নির্বাচনের একটি নতুন মডেল তৈরি করেছে, যে মডেলে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হচ্ছে। এই মডেলটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা থাকবে। পাশাপাশি সব আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবে এবং তারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করবে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমও নির্বাচন করবে। তবে তাদের যে দলগত সাংগঠিক শক্তি তাতে তারা নির্বাচনে বড় রকম প্রভাব ফেলতে পারবে বলে কেউ মনে করে না। ফলে এবারের নির্বাচন হবে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের নির্বাচন।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থীর ছড়াছড়ি। এমন কোনো আসন নেই যেখানে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী নেই। ফলে ভোটের লড়াইটা মূলত হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেই। তবে স্বতন্ত্র এসব প্রার্থীদের নিয়ে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে এরই মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে। মনোনয়ন ঘোষণার পর দেশের কয়েকটি এলাকায় হামলা ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। তবে প্রয়োজন হলে নির্বাচনের আগে তাদের লাগাম টানারও পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে ডামি প্রার্থী হলেন এমন প্রতিদ্ব›দ্বী যারা ভোটের মাঠে নামেন ঠিকই, কিন্তু তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য জয় নয়। নির্বাচনের মাঠে তাদের থাকে নানামুখী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভ‚মিকা। ভোটের সংখ্যা গণনার ক্ষেত্রে, ডামি প্রতিদ্ব›দ্বীদের ব্যালটে পড়া ভোটগুলো কোনো এক শক্তিশালী প্রার্থীর জন্য হতে পারে আশীর্বাদ। কারণ, ডামিরা মূলত ক্ষুদ্র জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে ভোটের ছক পাল্টে দিতে পারেন। নির্বাচনী ফলাফলে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো।
তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে একটি অভিনব পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনে নেই। ফলে এবার দলীয়ভাবেই আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্বাচনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাতে হয়ত নৌকা প্রতীক আর স্বতন্ত্র মিলিয়ে আওয়ামী লীগেরই এক আসনে একাধিক প্রার্থী থাকবে। কিন্তু এটা তো নদীর স্বাভাবিক গতি নয়। গতি আনার চেষ্টা। সব দল নির্বাচনে থাকলে তার উত্তেজনা, আগ্রহ আলাদা। তবে ডামি প্রার্থীদের কারণে তৃণমূলে কোন্দল এবং নির্বাচনের সময় সংঘাত, সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে তার ডামি প্রার্থী বা অনুগত দলগুলোর প্রার্থীদের নির্বাচন। কাজেই এটিকে নির্বাচন না বলে একদলীয় নির্বাচন বলা যেতে পারে। ২০২৪ সালে একতরফা ও সাজানো নির্বাচন হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট আরও ঘনীভ‚ত হবে। এই নির্বাচনে সরকারকে সমর্থনকারী দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে নানা অন্যায্য সুবিধা আদায় করে নেবে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেজনক। এটি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে।
তিনি বলেন, এবার এই একাধিক প্রার্থী নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কোন্দল ও সংঘাত ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দেখেছি সংঘাত হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন মনে করছেন, নিজ দলের মধ্যে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করায় সুবিধার পাশাপাশি কিছু ক্ষতির মুখেও পড়তে হতে পারে আওয়ামী লীগকে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নির্বাচনকে প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ দেখানোর জন্য নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট করার সুযোগ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা আসলে দলটির ছায়াপ্রার্থী।
তবে আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকে নিরীহ মনে হলেও ভোটের মাঠের চিত্র ভিন্ন রকম হতে পারে। এতে তৃণমূলে দলের কোন্দল আরও বাড়বে এবং সহিংসতা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ১৪ দলীয় জোট। এই জোটে রয়েছে- জাসদ (ইনু), সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাসদ, তরিকত ফেডারেশন এবং জেপি।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর ১৩টি আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। শরিকদের অনেকেই লড়েন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে। এবারের ভোটেও নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে ভোট করার কথা জানিয়ে ১৪ দলের ছয়টি দল নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। তবে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব শরিকরা। ১৪ দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল নিয়ে মহাজোট গড়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভোট বর্জন করায় জোট গঠনের প্রয়োজন হয়নি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সব সময়ই দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলেন, চেইন অব কমান্ড ফলো করেন। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তারপরও নেতাকর্মীরা আমাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। তাছাড়া নির্বাচনের ফলাফল যেটাই হোক, আওয়ামী লীগ তা মেনে নিবে। মনোনীত প্রার্থী হারলে পরাজিত বোধ করবে না আওয়ামী লীগ। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL