দেশের প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন কাজে কমবেশি বিদেশি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনা, পরিবহন কিংবা পরামর্শক ব্যয় মেটাতে হয় ডলারে। বিদেশ থেকে কোনো প্রকল্পের পণ্য পরিবহন করতে হয় জাহাজ বা উড়োজাহাজে। সেখানে ডলারের পাশাপাশি জ্বালানিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বিশ্বজুড়ে অস্থির হয়ে যায় ডলার ও জ্বালানি তেলের বাজার। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে প্রকল্পব্যয়-সময়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদে ব্যয় বাড়ছে। বেড়েছে জাহাজ ভাড়া। বিদেশের পোর্ট থেকে অনেক পণ্য ছাড়তেও দেরি হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে সব প্রকল্পে। এসব বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনকে চিঠি দিয়ে অবগত করা হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্প নেওয়ার সময় ডলারের একটা রেট ধরা হয়। হয়তো এমন প্রকল্প আছে ডলারের রেট ৮০ থেকে ৮৫ টাকা ধরে বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু এখন তা বেড়ে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা ছাড়িয়েছে। অনেক নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিসহ পরিবহন খরচও বেড়েছে। এসব প্রভাব পড়েছে প্রকল্পে। এমন অনেক সমস্যার কথা জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, এবছরের ১৬ ডিসেম্বর দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। এ রুট চালু হলে দ্রুততম সময়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছাবে ট্রেন। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ আনুষঙ্গিক কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়তে পারে প্রায় ৫শ কোটি টাকার বেশি। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ। সাংহাইয়ে আটকেপড়া রেললাইনের ট্র্যাক, লুপ, অ্যাঙ্গেল, রেলস্টেশনের গ্লাস ও কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনের ঝিনুক আকৃতির কাঠামো এখনো দেশে এসে পৌঁছায়নি। ফলে এগোয়নি কাজ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এসব মালামাল সমুদ্রপথে চীন থেকে দেশে আসবে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। এছাড়া বাড়তি ভাড়া দিয়েও মিলছে না শিপমেন্ট। প্রকল্পের অনেক যন্ত্রাংশ দেশেও পরিচালনা করা হয় ডিজেলে। ডলারের দাম বাড়ায় রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়তি। এসব নির্মাণসামগ্রী চলমান প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দেবে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এডিবি ডলারে ঋণ পরিশোধ করবে বলে অনেক ব্যয় কমে গেছে। তবে সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বর্তমানে মহাসংকট তৈরি হতো বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ডলার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদে ব্যয় বাড়ছে। বেড়েছে জাহাজ ভাড়া। বিদেশের পোর্ট থেকে অনেক পণ্য ছাড়তে দেরি হচ্ছে। এডিবি প্রকল্পের ঋণ ডলারে পরিশোধ করবে। এ কারণে বেঁচে গেছি, তা না হলে অনেক সমস্যা হতো। তারপরও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রড ও সিমেন্টের দাম বেড়েছে। প্রকল্পের আওতায় শত শত ইক্যুইপমেন্ট চলে তেলে। এসব কারণেও ব্যয় বাড়ছে।
বাংলাদেশ সরকার ও জাপানের উন্নয়ন সহযোগী জাইকার অর্থায়নে ‘উপজেলা পরিচালনা ও উন্নয়ন (ইউজিডি) প্রকল্পে’ ব্যয় বাড়ছে ২১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একই সঙ্গে মেয়াদও বাড়ছে আড়াই বছর। প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তনের কারণে ১৪৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকার অতিরিক্ত তহবিল পাওয়া গেছে, যা প্রকল্প ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা প্রয়োজন। এছাড়া ভ্যাট, আইটি, কনসালটেন্সি, বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া ইত্যাদি খাতের ব্যয় নতুনভাবে নির্ধারণ ও সমন্বয় করা হয়েছে।
প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় পরামর্শক খাতে জাপানের বরাদ্দ ছিল ৮৬৫ মিলিয়ন ইয়েন, যা বাংলাদেশি টাকায় ৫৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনের কারণে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, যা আগের বরাদ্দের তুলনায় ৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পরামর্শক ব্যয় বাড়ার কারণ হলো পরামর্শকদের প্রতিদিনের হিসাব অনুযায়ী জনমাসের সংখ্যা বেড়েছে। সেজন্য এ খাতে ব্যয়ও বাড়ছে। মুদ্রার বিনিময় হারে পরিবর্তনের কারণে বেড়েছে ১৪৪ কোটি টাকা। এছাড়াও অনেক উপজেলা তাদের বরাদ্দ অর্থ পাওয়ার পরও পুরোটা খরচ করতে পারেনি, ফেরত এসেছে। আবার সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকাও যোগ হয়েছে। ফলে তা সমন্বয় করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন।
এদিকে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। জুন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ। এই পর্যায়ে এসে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় এবং নতুন কিছু অবকাঠামো যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় কমপক্ষে ৮শ কোটি টাকা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতেই বাড়ছে ৫শ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ প্রকল্পের (কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প) উপ-প্রকল্প পরিচালক (অ্যাপ্রোচ রোড, সার্ভিস ফ্যাসিলিটিজ ও এনভায়রনমেন্ট) মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব প্রকল্পে আছে। অনেক ইক্যুইপমেন্ট বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে ৫শ কোটি টাকা লাগবে।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. মামুন-আল-রশীদ বলেন, ডলারের রেট ও জ্বালানি তেলের দামের প্রভাব প্রকল্পে যদি পড়ে তবে প্রকল্প সংশোধন করতে হবে। প্রকল্প সংশোধন করেই ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। পরে এটা একনেক সভা থেকে অনুমোদন নিতে হবে। তাছাড়া এ খাতে বাড়তি ব্যয় মেটাতে থোক বরাদ্দের কোনো সুযোগ নেই।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL