২১-নভেম্বর-২০২৪
২১-নভেম্বর-২০২৪
Logo
নারী ও শিশু

দেশে ভ্রুণ হত্যার চিত্র ভয়াবহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-২২ ১৬:৫১:৪৮
...

সরকারের প্রথমবার করা গর্ভবতী নারীদের নিয়ে জরিপে উঠে এসেছে ভ্রুণ হত্যার ভয়াবহ চিত্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এই জরিপে দেখা যায়, দেশে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ ভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে, যার মধ্যে অধিকাংশই ছেলে শিশু। ৩৫ বছর বয়সী (ত্রিশোর্ধ্ব) নারীদের মধ্যে ভ্রুণ হত্যার প্রবণতা বেশি।

২০২২ সাল থেকে চলা এ জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চলতি মাসে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২২’ প্রকল্পের আওতায় এ তথ্যসংগ্রহ করেছে বিবিএস। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর সঠিক হিসাব বের করতেই মূলত এ জরিপ করে সরকার। সারাদেশে ৯ হাজার ৯৪৩ জন গর্ভবতী নারীর তথ্যসংগ্রহ করেছে বিবিএস। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে শিশু পৃথিবীতে আসা পর্যন্ত এ তথ্যসংগ্রহ করা হয়।

বিবিএস জানায়, প্রথমবারের মতো প্রশ্নপত্রে অন্তর্ভুক্ত গর্ভবতী রেজিস্টার তফসিলের মাধ্যমে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে খানায় বসবাসরত ১০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীদের বর্তমান গর্ভধারণ অবস্থা সংক্রান্ত তথ্যসংগ্রহ করা হয়। গর্ভবতী রেজিস্টারে যেসব তথ্যসংগ্রহ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- গর্ভবতী নারীর নাম, বর্তমান (জরিপকালীন) বয়স, তাদের পূর্ববর্তী মাসে গর্ভাবস্থা, বর্তমান গর্ভাবস্থা, সর্বশেষ গর্ভাবস্থা শেষ হওয়ার সময়, সর্বশেষ গর্ভাবস্থার ফলাফল। এছাড়া গর্ভপাত করা শিশুর লিঙ্গ, বর্তমান গর্ভধারণের সময়ে মায়ের বয়স, গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার পদ্ধতি, সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখ, সারাজীবনে জীবিত ও মৃত মিলিয়ে জন্ম দেওয়া মোট শিশুর সংখ্যা এবং বর্তমানে জীবিত মোট শিশুর সংখ্যার তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত করা ভ্রুণের লিঙ্গ কী ছিল তা জানেন না প্রায় অর্ধেক (৪৯ দশমিক ৮২ শতাংশ) নারী। ৩৪ বছর বয়সী নারীদের বড় অংশের ক্ষেত্রে গর্ভপাত করা বেশিরভাগ ভ্রুণ ছিল ছেলে। যদিও ৩৫ বছর ও তার বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে গর্ভপাত করা বেশিরভাগ ভ্রুণ মেয়ে। তবে গর্ভপাত করা ভ্রুণের লিঙ্গের বিষয়ে উত্তর দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীরা।

বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২১ প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো সারাদেশে গর্ভবতী নারীদের তথ্যসংগ্রহ করেছি। সন্তান ধারণের দিন-তারিখ কবে থেকে শুরু হয়েছে, গর্ভের বাচ্চা মেয়ে না ছেলে এসব তথ্যসংগ্রহ করেছি। সন্তান প্রসবের পরও তথ্যসংগ্রহ করেছি।’

তিনি বলেন, ‘জরিপে দেখা গেছে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে গর্ভপাতের প্রবণতা বেশি, যার অধিকাংশই ছিল ছেলে শিশু। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে মা হন- এমন নারীদের তথ্যও সংগ্রহ করছি। এমন তথ্য পাচ্ছি না তা বলা যাবে না। এরই মধ্যে অন্তত ছয়জন মায়ের তথ্য পেয়েছি; যারা এখনো বিয়ে করেননি। কেউ যদি ভ্রুণ হত্যা করে সেই তথ্যও প্রকাশ করছি। তবে যার কাছ থেকে তথ্যসংগ্রহ করেছি তার তথ্যও আমরা গোপন রাখছি।’

জরিপে উঠে এসেছে, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে এমন নারীদের মধ্যে সারাজীবনে যেকোনো ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে এমন নারীদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৫৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বিয়ের সময়ে বয়স ২৫ থেকে ২৯ বছর ছিল এমন নারীদের মধ্যে এ হার আরও কম। ফলে দেখা যাচ্ছে বিয়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের জš§নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রবণতা কমেছে।

গর্ভবতী নারীদের মধ্যে সারাজীবনে নির্দিষ্ট ধরনভিত্তিক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবহার করেছেন ওরাল পিল (খাবার বড়ি)। গর্ভবতী নারীদের মধ্যে সারাজীবনে নির্দিষ্ট ধরনভিত্তিক ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কনডম দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এটি ব্যবহারকারীর হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশ।

তবে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে নির্দিষ্ট ধরনভিত্তিক জš§নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে সারাজীবনে কনডম ব্যবহারের হার ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এই বয়সীদের ৬১ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যবহার করেন ওরাল পিল। এছাড়া সারাজীবন নির্দিষ্ট ধরনভিত্তিক জš§নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে ইনজেকশন ব্যবহার করেছেন ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও ইমপ্ল্যান্ট শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এ পদ্ধতির ব্যবহার সর্বোচ্চ।

গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িতে কিটের সাহায্যে পরীক্ষা করে তাদের গর্ভধারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা করে তাদের গর্ভধারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়সী নারীদের ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ গর্ভধারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে। পল্লী অঞ্চলের তুলনায় শহরে বসবাসকারী নারীদের মধ্যে কীটের সাহায্যে পরীক্ষা করে গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার হার বেশি।

পল্লী অঞ্চলের গর্ভবর্তী নারীদের ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ ও শহর অঞ্চলের ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ বাড়িতে কিটের সাহায্যে পরীক্ষা করে গর্ভধারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে ধনী ও উচ্চশিক্ষিত নারীদের মধ্যে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে গর্ভধারণের বিষয় নিশ্চিত হওয়ার প্রবণতা বেশি। ধনী নারীদের ২৪ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষিতদের ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ গর্ভধারণ নিশ্চিত হতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন।

২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে জীবিত সন্তান প্রসবের হার সর্বোচ্চ ৮৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এ হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে জীবিত সন্তান প্রসবের হার ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে কম, ৬১ দশমিক ১৩ শতাংশ। যদিও মৃত সন্তান প্রসবের হার ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ, ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এ হার ৩৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ১৯ শতাংশ। অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ২৪ শতাংশ। ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। নারীদের মাসিক নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়াকে ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতের অংশে বিবেচনা করা হয়েছে। জীবিত সন্তান প্রসবের হার পল্লী অঞ্চলে ৮৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, শহর অঞ্চলে ৮৭ দশমিক ৮১ শতাংশ।

অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার শহর অঞ্চলে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, পল্লী অঞ্চলে যা ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। খুলনা বিভাগে জীবিত সন্তান প্রসবের হার সবচেয়ে বেশি ৮৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে এ হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অপরদিকে, ময়মনসিংহ বিভাগে অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার সবচেয়ে বেশি ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং সিলেট বিভাগে এ হার সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।

সম্পদের বিবেচনায়, জীবিত সন্তান প্রসবের হার দরিদ্র নারীদের মধ্যে সবচেয়ে কম, ৮৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। দরিদ্র নারীদের মধ্যে সব ধরনের গর্ভপাতের হার বেশি। এছাড়া নারীদের মধ্যে শিক্ষাস্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণমেয়াদি গর্ভাবস্থাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জানায়, বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে গর্ভপাত আইন (১৮৬০-এর ব্রিটিশ পেনাল কোড) অনুযায়ী, অন্তঃসত্ত্বার জীবন বাঁচানো ছাড়া অন্য কোনো কারণে গর্ভপাত নিষিদ্ধ।

/মামুন