নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর ২০২২-২০২৩। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঘাতে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশও। সেইসাথে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায় হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। আবার শুরু হয়েছে করোনার চতুর্থ ঢেউ। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার বড় চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অস্বাভাবিক আমদানি বৃদ্ধি অর্থনীতিকে যে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, সেই ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরাও আরেকটি চ্যালেঞ্জ। এরকম পরিস্থিতিতে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই ১ জুলাই শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে ২০২২-২৩ নতুন অর্থবছর।
এদিকে, আমদানি কমার কোনো সুখবর দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছে, নতুন বছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৭ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। আর বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে এই ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, দেশে রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ৩৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। নতুন মুদ্রানীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) তথ্য প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায় এই ১০ মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে অর্থবছরের বাকি দুই মাস (মে ও জুন) শেষ হয়ে গেছে। সেই দুই মাসের তথ্য যোগ করে বৃহস্পতিবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে ৩২ শতাংশ প্রবৃিদ্ধি হবে। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে আসবে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়বে ৩৫ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমবে ১৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ক্যারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
নতুন অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমে ১৩ শতাংশে নেমে আসবে। আমদানি ব্যয় বাড়বে ১২ শতাংশ। রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং ১৫ শতাংশ বাড়বে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
আমদানিতে জোয়ারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি চূড়ায় উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) চেয়েও ২১ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-এপ্রিল সময়ের চেয়ে বেশি প্রায় ৫৩ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। এর আগে কখনই কোনো অর্থবছরে এত বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি বাংলাদেশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৬৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে ৪৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে এই ১০ মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪১ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। এ হিসাবেই ১০ মাসের হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
এর ফলে ব্যালান্স অফ পেমেন্টেও বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে; অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে মাত্র ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল।
পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে বাংলাদেশ এই মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই আমদানিতে জোয়ার বইছে। আর এতে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান বা বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; তারপরও তেমন আমদানি কমছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় রপ্তানি আয় কমলেও আমদানি কমার কোনো লক্ষণ দেয়া যাচ্ছে না। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও নিম্নমুখী। সব মিলিয়ে দিন যত যাচ্ছে, অর্থনীতিতে সংকট ততই বাড়ছে। করোনা মহামারির ধাক্কা থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিলাম। এরই মধ্যে যুদ্ধ নতুন সংকটে ফেলে দিয়েছে। বন্যায় বড় ক্ষতি হচ্ছে। এতো কিছুর মধ্যে নতুন করে আবার করোনা বাড়তে শুরু করেছে। এতে বোঝাই যাচ্ছে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আতঙ্কের মধ্যেই কাটাতে হবে নতুন অর্থবছর।
আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন (৪ হাজার ২০০কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ কয়েকদিনের মধ্যেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল- প্রতি মাসেই ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। এ হিসাবেই বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। দুই মাস পর পর আকুর দেনা পরিশোধ করতে হয়।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL