ফ্রেন্স শব্দ হতে ফেঞ্চুগঞ্জ নামের উৎপত্তি কিনা জানি না। তবে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলাটা যেন মায়াবি প্রকৃতির চাদরে মোড়ানো ষোলোকলায় পূর্ণ। সেখান থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন ‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র চিফ অর্গানাইজার মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম।
সিলেট জেলা প্রেস ক্লাবের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক নবেল ভাইয়ের সহযোগিতায়, মানবতার কল্যাণে আয়োজিত একটি প্রোগ্রামে ‘দে-ছুট’ সংগঠনের বন্ধুরা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় গিয়েছিলাম।
যাওয়ার পরপরই আমরা নিজেদের মতো করে ফেরিঘাটের পাশে রাজনপুর গ্রামে চিরশায়িত হজরত শাহ্ মালুম [র.] মাজার দর্শন ও গাল্লিবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরখ করে নিয়েছি। জায়গাটা খুবই নৈসর্গিক।
মাজার শরীফ আর বিলের মাঝে সমান্তরাল রেললাইন সত্যিই ভালোলাগার মতো অনুভূতি কাজ করে। গাল্লিবিলে মাছ ধরার দৃশ্য আর হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুটে চলার ঝিকঝিক শব্দ শুনার ফাঁকে পোগ্রামের জন্য সেলফোনে তাড়া আসে।
স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদউদ্দিন দাদা ভাই, আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে অপেক্ষায় আছেন। ওদিকে দুস্থ মানুষগুলোও পিঠাইটিকর গ্রামের স্কুল মাঠে জড়ো হয়েছেন। তাই আর সময়ক্ষেপণ না করে আমরা দ্রুত সেখানে চলে যাই। শুরু করি ত্রাণ বিতরণ।
সীমিত সাধ্যের মধ্যেও অসহায় মানুষগুলোর মুখে ক্ষণিকের জন্য হাসি ফুটাতে পেরে আমরাও বেশ পুলকিত হই। বেলা প্রায় ১১টায় শুরু হওয়া প্রোগ্রামের সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিসমাপ্তি হতে হতে প্রায় ২টা ৩০ মিনিট বেজে যায়। ত্রাণ কার্যক্রম শেষে স্বভাবসূলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
ফরিদ উদ্দিন দাদা ভাইকে চেপে ধরলাম- ভাই এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখান। ইতোমধ্যে পূর্বপরিচিত বড়লেখা উপজেলার আরো দুই সাংবাদিক তপন দাদা ও লাভলু ভাইও এসে হাজির। সিলেটে আমি আছি শুনে বেশ সাংঘাতিকভাবেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে মোটরবাইকে চলে এসেছেন।
আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য দাদা ভাইও রাজি। প্রথমে ভাবে ছিলেন কিন্তু আদি ঢাকার পোলাপানগো কাছে কোনো ভাবই টিকে না- তা আরও একবার প্রমাণ করেছি।
পিঠাইটিকর থেকে চলে যাই কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেঁষে মল্লিকপুর গ্রামের প্রগতি যুব সংঘ ক্লাবে। দাদা ভাইয়ের সৌজন্যে সেখানে চলে দুপুরের খানাপিনা। আলাপচারিতায় জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে এ গ্রামের বীরত্বের ইতিহাস।
দৃষ্টিনন্দন কুশিয়ারা নদীর ওপর ঐতিহাসিক কুশিয়ারা রেল ব্রিজ; যা সিলেটের সাথে বাংলাদেশের একমাত্র রেল যোগাযোগের মাধ্যম। স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এই রেল ব্রিজ হতে আমাদের মু্ক্তিকামী গেরিলা বাহিনী প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
এই ব্রিজের দক্ষিণপ্রান্ত হতে পার্শ্ববর্তী ইলাশপুর রেল ব্রিজে হানাদার বাহিনীর ট্রেন, গেরিলা বাহিনী বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই বীরত্বপূর্ণ হামলা পাকিদের কবল হতে সিলেট মুক্ত হওয়ার জন্য বিশেষ অবদান রাখে।
দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ অন্যদের চাইতে অনেকটাই ব্যতিক্রম। আমরা কোথাও ঘুরতে গেলে নিজেদের বিনোদনের পাশাপাশি, সে জায়গার প্রকৃতি-পরিবেশ, ইতিহাস ও মানুষের জীবনমান জানারও প্রবল আগ্রহ থাকে।
সাধ্য অনুযায়ী সংগঠনের পক্ষ হতে সেসব এলাকার উন্নয়ন ও অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার চেষ্টা থাকে।
এরপর বিকালের সোনামাখা রোদ সঙ্গী করে চলে যাই ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্ট। এখান থেকেই শুরু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। পর্যটকদের জন্য ঘাটে বাঁধা নানান প্রকারের নৌযান।
শতবর্ষী বটবৃক্ষের ছায়ায়, বিশাল হাওরের বিশুদ্ধ বাতাসের ঝাপটা লাগে গায়ে। থই-থই করা পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মন আর বাধ মানে না।
এরই মধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন সুরমানিউজ২৪.কমের সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। তাকে নিয়েই এবার ট্রলারে করে ছুটলাম বিশাল জলরাশীর বুকে। পড়ন্ত বিকালে হাওরের বুকে ভেসে চলা ট্রলারে তপন দাদার কণ্ঠে, ভাটিয়ালি গান শুনতে শুনতে ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছাই। ট্রলার ছেড়ে একেবারে টাওয়ারের উপরে গিয়ে উঠি।
ওয়াও! সু-উচ্চ টাওয়ার হতে চারপাশের নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর লাল আভা ছড়ানো সূর্যাস্ত, ভ্রমণপিপাসুদের মাঝে এক অন্যরকম উম্মাদনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। এর আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর, তারমধ্যে শুধু বিলের আয়তনই ৪,৪০০ হেক্টর। বুঝতেই পারছেন এর নয়নাভিরাম নান্দনিকতা কেমন হতে পারে।
ওয়াচ টাওয়ারে আমাদের আড্ডাবাজি যখন চরমে, তখনই বর্তমানে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাওয়া বেলাল পানিতে দিল লাফ। এবার শুরু হল কে কত লাফ দিতে পারে। আমিও পানিতে নামবো কিনা কেউ একজন জানতে চেয়েছিল।
আমি তখন সাত-পাঁচ না ভেবে উত্তর দিলাম আবার জিগায়। আমিও দিলাম এক লাফ। বেশ খানিকটা সময় ধরে চলল ডুবাডুবি। দে-ছুটের দল ভিজে জবুথবু। যেন ভেজা কাপড়েই অনাবিল সুখ। ভর সন্ধ্যা, মাঝির হাঁকডাক।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL