২২-নভেম্বর-২০২৪
২২-নভেম্বর-২০২৪
Logo
সারাদেশ

ঢাকায় পানির তীব্র সংকট

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২২-০৯-০১ ১৯:০১:০২
...

আব্দুল হাই রঞ্জু

মানুষের বেঁচে থাকার বড় নিয়ামক পানি।  পানি ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে বলা হয় পানির অপর নাম জীবন।  সেই জীবন রক্ষার পানির হাহাকার সর্বত্রই।  বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ।  প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস ঢাকা শহরে। দিন যতই যাচ্ছে, ততই ঢাকার জনসংখ্যা বাড়ছে এবং জীবন ধারণের জন্য পানির চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।  অথচ থাকায় বিদ্যুৎ সমস্যা, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ নানা কারণে পানির তীব্র সংকট দিন দিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।  বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে পানির পাম্পগুলো চালানো সম্ভব হচ্ছে না।  আবার গোটা শহরে ৮০০টি পাম্পের মধ্যে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় প্রায় ১০০টি পাম্প বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।  যদিও এসব পাম্পের বরিং কাজ চলছে।  বরিং করে নতুন পাইপ সংযোগ দিলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, পাম্পগুলো চালু করা সম্ভব হবে।  আশা করছি, পাম্পগুলো চালু হলে পানির তীব্র সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।  তবে সমস্যা হচ্ছে, বিদ্যুৎ রেশনিং করে ঢাকায় পাম্পগুলো চালাতে হচ্ছে।  যেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাম্পগুলো চালালেও পানির চাহিদা পূরণ হয় না, সেখানে বিদ্যুতের কারণে পাম্পগুলো বন্ধ থাকলে চাহিদার পুরো পানি উত্তোলন হবে কী করে? ঢাকা ওয়াসার সূত্র মতে, যেখানে ঢাকায় ২৬৫ কোটি লিটার পানির চাহিদা।  সেখানে বিপুল পরিমাণ পানি ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা সম্ভব হয় না।  চাহিদার প্রায় ৬৫ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করার কথা। চাহিদার অবশিষ্ট পানি ভূউপরিস্থ বা পানি শোধনাগার প্লান্ট থেকে সরবরাহ দেওয়ার কথা।  কিন্তু সেখানেও বিপত্তি।  পানি শোধনাগার কোনো কোনো প্লান্টের কাজ শুরু হলেও সেসব দীর্ঘ দিনেও শেষ হয়নি।   ফলে পানির কদর দিন দিন বেড়েই চলেছে।  জানা গেছে, রূপগঞ্জের গন্ধবপুর পানি শোধনাগারের কাজ চলছে।  এই প্লান্ট চালু হলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে আসবে।  সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে ছোট বড় প্রকল্পের কাজ প্রাক্কলনের নির্ধারিত সময়ে শেষ হতেই চায় না।  শুধু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে এবং ব্যয় বরাদ্দও বাড়ে। রূপগঞ্জ প্রকল্পের ভাগ্যে কী আছে, তা এই মুহূর্তে বলাও কঠিন।  তবে আমরা চাই, যেহেতু প্রকল্পটি চালু হলে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ হবে, সেহেতু যত দ্রুত সম্ভব প্লান্টটি চালুর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।  অপরদিকে মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে  রাজধানীতে সরবরাহ করতে আজ থেকে ৯ বছর আগে সোয়া পাঁচ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল ওয়াসা।  জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির মেয়াদ তিন দফায় বৃদ্ধি করার পরও এখন পর্যন্ত এই কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে আট হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।  শেষপর্যন্ত এই প্রকল্প ব্যয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে, যা বলাও কঠিন।  তবে ওয়াসা রাজধানীর পানির চাহিদা পূরণ করতে নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করেছে সত্য, কিন্তু তা সহজে আলোর মুখ দেখছে না।  অথচ ওয়াসার দেখভাল করার জন্য রাষ্ট্রপতির চেয়ে বেশি বেতনে বসে থাকা ওয়াসাপ্রধান কী করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আদালতপাড়া পর্যন্ত।  একই অবস্থা পদ্মা নদীর পানি শোধনাগার প্রকল্পেরও।  রাজধানীতে পানি সরবরাহের লক্ষ্যে তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হলেও পানির সরবরাহ লাইন আজও স্থাপন করতে পারেনি ওয়াসা।  ফলে উক্ত শোধনাগারের লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশই অব্যবহূত থাকছে দুই বছর ধরে। 

বাস্তবেই ঢাকা ওয়াসা একটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলেও এ প্রতিষ্ঠান রাজধানীবাসীর পানির সমস্যা সমাধান করতে পারছে না।  ফলে যেনতেনভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে পানির চাহিদা মেটানোর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হু হু করে নিচে নেমে যাচ্ছে।  এতে সমস্যা দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে।  ঢাকা শহরের পানির স্তর যদি আরও নিচে নেমে যায়, তাহলে উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত পানি ঢাকার ভূগর্ভে ঢুকে পড়বে।  তখন কিন্তু ঢাকার মানুষের সুপেয় পানি পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে।  ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কিছুদিন আগে বৃষ্টি নেই তবু সাগরের পানি চট্টগ্রাম শহরের ব্যবসা কেন্দ্র খাতুনগঞ্জে পানি ঢুকে ছিল।  কারণ সাগরের ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এখন জোয়ারের পানি সমুদ্র থেকে ওঠে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে।   স্বভাবতই ভয় হচ্ছে, সমুদ্রের ভূপৃষ্ঠ যদি এভাবে উঁচু হতে থাকে, আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যদি আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নামতে থাকে, তাহলে সমুদ্রের লোনা পানি রাজধানী কিংবা এর আশপাশের জেলাগুলোর ভূগর্ভে অনায়াসে প্রবেশ করবে।  তখন পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হবে, যা কল্পনার সীমাকেও অতিক্রম করবে।  যে কারণে মেগাসিটি ঢাকার মানুষকে পানি খেয়ে বাঁচাতে হলে এখনই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।  আর বৃষ্টির পানি ধারণের মতো প্রকল্প আমাদের হাতে নেই, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা সহজেই কমছে না।   তবে নদীর পানি পরিশোধন করে ব্যবহারের প্রকল্পগুলোর দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নজর দিতে হবে।   তদারকি, মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে।   ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।  যেন যত দ্রুত সম্ভব নদীর পানি শোধনাগার প্লান্টগুলোর কাজ শেষ করা সম্ভব হয়।   শুধু ঢাকা ওয়াসার ব্যর্থতাই শেষ নয়, রাজশাহী ওয়াসার ব্যর্থতার চিত্রও একই রকম। রাজশাহী শহরের পানির চাহিদা পূরণে ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকার পানি পরিশোধন প্রকল্পটি চীনের ঋণের টাকা আটক এবং পাইপ লাইন বসানোর জায়গা নিয়ে জটিলতায় প্রকল্পটির কাজ শেষও হচ্ছে না।  ফলে নগরবাসী সুপেয় পানিও পাচ্ছেন না।  ফলে ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ বাড়ছে এবং সে পানিও অনেক ক্ষেত্রে পানযোগ্যও নয়।  খোদ ওয়াসার উদ্যোগেই পরিচালিত এক পরীক্ষায় পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।  পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া থাকলে সে পানি পানযোগ্য নয়।  অথচ নগরবাসী নিরুপায় হয়ে সেই পানিই পান করছেন।  অথচ বরেন্দ্র অঞ্চলের কারণে রাজশাহী ও এর আশপাশের জেলার পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।  ৮ শত কিংবা হাজার ফুটের গভীরতা ছাড়া পানি পাওয়া দুষ্কর।  যে কারণে পদ্মার পানি শোধনাগার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা একান্তই জরুরি।  কিন্তু রাজশাহী ওয়াসা নানামুখী জটিলতার কারণে বিশেষ করে সড়ক বিভাগের জায়গা নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসন না হওয়ায় পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ শেষ করতে পারছে না।  অথচ ২০১৮ সালে অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে। 

বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু নদীর পানি পরিশোধন প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না।  নদীতেও এখন পর্যাপ্ত পানির অভাব।  বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণ উপযোগী প্রকল্প এখন জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত।  শুধু নগর-মহানগর নয়।  মফস্বল শহর এমনকি উপজেলা পর্যন্ত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ উপযোগী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।   দেশের মানুষ বাড়ছে হু হু করে।  অথচ পানির প্রাপ্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যেমন ভূগর্ভস্থ পানি কমে আসছে, তেমনি নদীনালা শুকিয়ে যাচ্ছে।   ফলে মানুষের জীবন রক্ষাকারী পানির সংকট নিয়ে জাতীয় বাজেটে বেশি করে বরাদ্দ রেখে অধিক সংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।   কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য পানির নির্বিঘ্ন সরবরাহ এবং ভূগর্ভস্থ পানির আধারকে কোনোভাবেই নিঃশেষ করে ফেলা যাবে না।  পানিও অফুরন্ত নয়। এরও শেষ আছে।  ফলে পানি ব্যবহারেও আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে এবং সেচভিত্তিক চাষাবাদ কমিয়ে আনতে হবে।  এজন্য কৃষিবিজ্ঞানীদের স্বল্প সেচে কিংবা বিনা সেচে খাদ্যশস্য চাষাবাদের উদ্ভাবন করতে হবে।  যে কারণে কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্য বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ বেশি করে রাখতে হবে।  স্মরণে রাখতে হবে, ছোট্ট ভূখণ্ডের বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ যেমন কমে আসছে, তেমনি জনসংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।  এই বিপুল পরিমাণ মানুষের দীর্ঘ মেয়াদে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য যেমন কৃষি চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে হবে, তেমনি সুপেয় পানির উৎসগুলোকেও ধ্বংস করা যাবে না।  যে কারণে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণের দিকে আমাদের বেশি করে নজর দিতে হবে।  তা না হলে পানির অভাবে অদূর ভবিষ্যতে আগামীর প্রজন্মের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।  বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার যথোপযোগী ত্বরিত কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। 

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা