বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানি করা চালের শুল্ক প্রত্যাহার করা হলেও দুর্বল তদারকির কারণে লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কঠোর নজরদারি করা না হলে এর সুফল থেকে বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ। লাভবান হবেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। বিফলে যাবে সরকারের ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা।
দেশে চালের বাজারে অস্থিরতা এমন একসময় শুরু হয়েছে, যখন ভরা মৌসুম। এ মৌসুমে বাজারে চালের সরবরাহ সবচেয়ে বেশি থাকে। গত কয়েক দিনে চালের বাজারে যেভাবে দাম বেড়েছে, তা অস্বাভাবিক। চাল আমদানিকারকরা বলছেন, ডলারের উচ্চমূল্য ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের দামে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়া, সরকারিভাবে চাল আমদানি না হওয়া ইত্যাদি কারণে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
তবে সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায় থেকেই দাম বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলতে পারছেন না কেউ। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চালের ঘাটতি আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা মজুতদারি করছেন। আবার বাজারে ঘাটতি আতঙ্কও নানাভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও চালের বাজারে অস্থিরতার কারণ শনাক্ত করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো পর্যালোচনা নেই।
তবে সরেজমিনে চালের বাজার অনুসন্ধান করে দামবৃদ্ধির বেশ কিছু কারণ জানতে পারা গেছে। সেগুলো হচ্ছে-দেশে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ধান উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস এবং তা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার, সংকট পুঁজি করে অনৈতিক মুনাফার আশায় ধান-চালের মজুত, বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়া ও দাম বেড়ে যাওয়া, চালকলে চাল উৎপাদন আগের তুলনায় কমে যাওয়া, খোলাবাজার থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ধান-চাল কেনা, সরকারিভাবে চাল আমদানি না হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দাম এবং ২৫ শতাংশ শুল্কভার নিয়ে চাল আমদানিতে বেসরকারি খাতের নিরুৎসাহিত মনোভাব এবং ডিজেলের দামবৃদ্ধিতে চাল উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি।
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা বলেন, চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঘাটতি। তিনি বলেন, চাল ব্যবসায়ীদের যেটা হিসাব, সেটা হলো ধান উৎপাদনে ঘাটতি আছে। তবে কী পরিমাণ ঘাটতি আছে, সরকার তার হিসাব স্পষ্ট করছে না। নানা মাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ীদের ধারণা জন্মেছে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দেশে ধান উৎপাদন ঘাটতি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন। মূলত এটিই হলো অস্থিরতার বড় কারণ। আবার এটাও সত্য, এই মৌসুমে চালের বাজার অস্থির হওয়ার কথা নয়।
এরকম পরিস্থিতিতে বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানি করা চালের শুল্ক প্রত্যাহার করেছে সরকার। উদ্দেশ্য বাজারে সরবরাহ বাড়ানো। আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে। ফলে জনগণ সহনীয় দামে চাল কিনতে পারবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত রোববার প্রজ্ঞাপন জারি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের শুল্ক কমানোর বিষয়টি জানিয়েছে এবং ওই দিন থেকেই নতুন শুল্কহার কার্যকর হয়েছে।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরবরাহ বাড়াতে ১ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে এ চাল আনা হবে। এনবিআর সূত্রে বলেছে, আগে চাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক ছিল। এখন ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক রেখে বাকি সব শুল্ক তুলে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, যে পরিমাণ শুল্ক কমানো হয়েছে, তাতে প্রতি কেজি চালে অন্তত ১০ টাকা কমে আসার কথা।
সমপ্রতি খুচরা বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে, কেজিতে তিন থেকে চার টাকা। এতে বেকায়দায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে দেশের নির্ধারিত আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর জিনিসপত্রের দাম কমাতে শুল্ক-কর প্রত্যাহার, ডিজেলের দাম কমানো, চাল আমদানি বাড়ানোসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, সরকারের রাজস্ব ক্ষতি স্বীকার করেও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে জনকল্যাণে শুল্ক কমানো হয়। কিন্তু দেখা গেছে, দাম তো কমেই না, বরং একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী লাভবান হয়।
আমদানি করা চাল থেকে ভালো রাজস্ব পায় এনবিআর। নতুন করে শুল্কছাড়ের ফলে এ খাত থেকে কমপক্ষে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে।
এনবিআর সূত্র বলেছে, শুল্কছাড়ের বিদ্যমান সুবিধা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে। এনবিআরের সাবেক সদস্য আলী আহমেদ বলেন, শুল্ক-করে ছাড় দেওয়া হলেও দুর্বল তদারকির কারণে অনেক ক্ষেত্রে এর লক্ষ্য পূরণ হয় না। মাঝখান থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা এর সুফল ভোগ করে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL