২৫-নভেম্বর-২০২৪
২৫-নভেম্বর-২০২৪
Logo
অপরাধ

কিডনি-লিভার বিক্রি হচ্ছে ফেসবুকে!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২২-০৮-০৫ ১৮:৩০:৫৩
...

কিডনি ও লিভার বিক্রির দেয়া হচ্ছে বিজ্ঞাপন।  এটা শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্যি।  এমন বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে ফেসবুকে নানা পেজ খুলে।  বিজ্ঞাপন দেখে মনে হতে পারে, এটি যেন কিডনি লিভার বেচা-কেনার হাট।   তবে বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে কিডনি বিক্রি করলেও টাকা পাননি।  উল্টো হত্যার হুমকি পেয়েছেন।   সম্প্রতি র‍্যাব এমন একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে।   

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘কিডনি নেটওয়ার্ক’ নামে একটি পেজে ২৯ জুলাই একটি পোস্ট দেয়া হয়।  তাতে লেখা হয়, এ প্লাস লিভার ডোনার লাগবে, আর্জেন্ট কাজ হবে।  পাসপোর্ট থাকতে হবে।  ওজন ৭০ কেজি হতে হবে।  ইনবক্সে যোগাযোগ করুন।  একই পোস্ট ফেসবুক পেজে দিয়েছে উত্তরবঙ্গ কিডনি রোগী হেল্প সেন্টার।  

কিডনি ডোনার ও ট্রান্সপ্লান্ট পেসেন্ট নামে আরেকটি ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া পোস্টে উল্লেখ করা হয় লিভার ডোনেট করতে চাই।  ব্লাড গ্রুপ- ও পজিটিভ।  এভাবেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পরে ইনবক্সে ও মোবাইলে যোগাযোগের মাধ্যমে কিডনি ও লিভার দাতাদের আকৃষ্ট করে কাছে টানা হয়।  তারপর দর কষাকষির মাধ্যমে কিডনি ও লিভার কেনাবেচা হয়।  এতে অভাবের তাড়নায় যিনি কিডনি বা লিভার দিলেন তিনি আর্থিকভাবে খুব একটা উপকৃত না হলেও দাতাকে বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা গ্রহীতার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপরের তিনটি পেজ থেকেই কিডনি, লিভার কেনাবেচা হয়।  এরকম অন্তত শতাধিক পেজ রয়েছে যেগুলোতে কিডনি কেনাবেচা হয়।  আগে কিডনি ও লিভার কেনাবেচার জন্য একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র দেশের উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলার দরিদ্রপীড়িত এলাকার মানুষকে টার্গেট করে মাঠে কাজ করত।  কিন্তু এখন সময় বদলেছে।  মাঠে গিয়ে কিডনি ও লিভার কেনাবেচার তৎপরতা না চালিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র কৌশলে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করছে।  

এর প্রমাণও পাওয়া যায় সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায়।  সমপ্রতি পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় কিডনি ও লিভার বিক্রি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।  তাদের গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সামপ্রতিক সময়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কিডনি ও লিভার কেনার নিরাপদ হাট হিসেবে ব্যবহার করছে বেশ কয়েকটি চক্র।  কিডনি ক্রেতা ও বিক্রেতারা এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দামাদামিও করছে।   

অন্যদিকে প্রলোভনে পড়ে অতীতে যারা কিডনি বিক্রি করেছিলেন, তাদের অনেকেই এখন কিডনি বিক্রির দালালে পরিণত হয়েছেন।  তারা নিজেদের কিডনি বিক্রি করে টাকার জন্য অন্যদেরও বিক্রি করতে উৎসাহিত করছে।  নিজেরাই প্রতারকদের দালাল হিসেবে কাজ করছে।  
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান অনলাইনে কিডনি কেনাকাটার বাজার সক্রিয়।  এ চক্রের সদস্যরা ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে আবারও নতুন করে বড় পরিসরে একই অপরাধে যুক্ত হয়।  অনেকে কাজ না পেয়ে কিডনি কেনাবেচায় বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে।
সমপ্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি কেনাবেচার সংঘবদ্ধ চক্রের ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।  তাদের গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব বলছে, দালালচক্র দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনলাইনে কিডনি কেনাকাটা করছে।  যাদের কিডনির দরকার তারা বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি এর শিকার হচ্ছে।  যাদের টাকার দরকার তারা ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে কিডনি বিক্রি করে দিচ্ছেন।  তবে বিক্রেতারাও অনলাইনে কিডনি বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।  


র্যাব জানায়, যারা অনলাইনে কিডনি কেনাবেচা করছে তারা নিম্ন আয়ের মানুষকে একটা কিডনি বিক্রির জন্য ৪-৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে সেই টাকা দেয় না।  একটি কিডনির জন্য প্রথমে ২ লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা পরে দেওয়ার কথা বলে।  কিন্তু পরবর্তীতে বাকি টাকা চাইলে কিডনি বিক্রেতাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখায় প্রতারক চক্রের সদস্যরা।

গোয়েন্দারা বলছেন, অনলাইনে কিডনি কেনাবেচার প্রায় শতাধিক প্ল্যাটফরমকে চিহ্নিত করা হয়েছে।  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকা কিডনি কেনাবেচার বেশ কিছু পেজ দেশের বাইরে থেকে তদারকি করে প্রতারকরা।  দেশে যেসব প্ল্যাটফরম আছে বা যা চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।  

র‍্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমিন বলেন, কিডনি কেনাবেচা বন্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় কিডনির ব্যবসা বড় পরিসরে চলছে।  তিনি বলেন, দেশের নিম্নআয়ের মানুষ অনেকে টাকার অভাবে কিডনি বিক্রি করছে। প্রতারকরা এদের কিডনি নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করছে।   এসব প্রতারক ভারতের যেকোনো হাসপাতালের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে দীর্ঘদিন ধরে এসব অপরাধ করে আসছে।  এ চক্রটি একটি কিডনির জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে ২০-২৫ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন।  

র‍্যাব সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচার সংঘবদ্ধ বড় একটি চক্রের প্রধান মো. শহিদুল ইসলাম মিঠুকে সমপ্রতি গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তিনি এর আগেও গ্রেপ্তার হন।  সিআইডি তাকে গ্রেপ্তার করেছিলো।  কারাগার থেকে বের হয়ে আবারও বড় পরিসরে তিনি একই কাজ করে যাচ্ছেন।  এ কাজে একটু ঝুঁকি থাকলেও অতিরিক্ত টাকা রয়েছে।  শহিদুল মিঠুর এ চক্রটি অনেক দিন ধরে ফেসবুকে অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচা করত।  তারা প্রায় শতাধিক কিডনি বেচাকেনা করেছে।  এ চক্রটি একটি কিডনি বিক্রির জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিত।  কিন্তু তারা কিডনি দাতাকে দিত মাত্র ২ লাখ টাকা।  গরিব ও অসহায় মানুষ চিহ্নিত করে একটি টার্গেট নিয়ে এ অপরাধ করত তারা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করা হয়।  এরপর ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাঠিয়ে মূলত সেখানেই কিডনি নিয়ে থাকে চক্রটি।  

তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি সারা দেশে বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি কেনাবেচা করা হচ্ছে।  এসব অপরাধ দমনে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ নজরদারি বৃদ্ধি করেছি।  খন্দকার মঈন আরও বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কিছু চক্রের সদস্যদের আমরা আইনের আওতায় এনেছি, বাকিদের ধরতে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।  

কিডনি বিক্রির এমন চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতারণার শিকার জয়পুরহাটের আব্দুল মান্নান বলেন, আমি অভাবের তাড়নায় একটি কিডনি বিক্রি করি।  একটি কিডনির বিক্রির জন্য আমাকে ৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল।  কিন্তু এ চক্রের সদস্যরা প্রথমে আমাকে ২ লাখ টাকা দেয়। এরপর আমি বাকি টাকা চাইলে বলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিবে।  

অনলাইন প্ল্যাটফরম থেকে কুড়িগ্রাম এলাকার একজনের (প্রতিনিধি) সঙ্গে যোগাযোগ করে কিডনি বিক্রি করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন মো. তাজুল ইসলাম।  তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রতিটি কিডনি বাবদ তারা আমাদের ৪-৫ লাখ টাকা দিতে চেয়েছে।  আমি অভাবের তাড়নায় নিজেও একটি কিডনি বিক্রি করে দিয়েছি।  পরে আরও ৪টা কিডনির ডোনারের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।  কিন্তু সঠিক মতো কোনো কিডনি বিক্রির টাকা পাইনি বরং প্রতারিত হয়েছি।  এর পরে আমি এ বিষয়টি র্যাবকে জানায়।  

একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অনলাইনে কিডনি ক্রয়-বিক্রয় করতে গিয়ে পাশের দেশ ভারতে প্রায় ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি আটক রয়েছে এবং আমাদের দেশেও এ চক্রের অন্যতম প্রধান আসামিসহ প্রায় ৩০-৪০ জন সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে। অনেকে কারাগারে, আবার অনেকে জামিনে রয়েছে।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার (সিআইডি) পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বেশ কিছু কিডনি বেচাকেনা চক্রের সদস্য ধরা পড়েছে।  বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে সিআইডি কাজ করছে।