নিজস্ব প্রতিবেদক
আকরামুজ্জমান আরিফ
২০২০ সালে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মালিহাদ ইউনিয়নের আশাননগর গ্রামে অবস্থিত ঝুটিয়াডাঙ্গা পাঙ্গাশিয়া নদী খননের জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে সেই প্রকল্পের কাজ ৪ বছরেও শেষ হয়নি। খননে যেখানে সুফল মেলার কথা সেখানে প্রায় পানি শূণ্য নদীর বড় অংশ জুড়ে। ঠিকাদারের অবহেলা, অপরিকল্পিত খনন আর অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ২১টি জেলে পরিবার বিপাকে পড়েছে। লাভের আশায় বৈশাখের আগে ১৭ লাখ টাকার বেশি অর্থ দিয়ে নদী মাছ চাষের জন্য ইজারা নিলেও পানি না থাকায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে। জেলেদের অভিযোগ তাদের না জানিয়ে এলজিইডি প্রকল্প হাতে নেয়। আর যে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনি কাজই জানেন না। তাই নদীর দুই পাশ খুড়ে পাড় তৈরি করা হয়েছে। মাঝে খনন না হওয়ায় তাদের কোন কাজে আসছে না। পাড়ে মাটি ফেলায় বৃষ্টির পানি আগে নদীতে পড়লেও এখন তাও বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। এভাবে ৬০ লাখ টাকা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,কুমার নদীর অংশে প্রায় ৪৪ একর ঝুটিয়াডাঙ্গা পাঙ্গাশিয়া নদী জলকর রয়েছে। প্রতি বছর জেলা প্রশাসকের রাজস্ব শাখা থেকে জলকরটি মাছ চাষের জন্য মালিহাদ মৎস্যজীবী সমাবায় সমিতি ইজারা নিয়ে আসছে। চলতি বছরও প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকার জলকরটি ইজারা নিয়েছে সমিতির সদস্যরা। তবে বিপত্তি জলকরের যে অংশে খনন করা হচ্ছে ৪ বছর ধরে সেখানে কোন পানি নেই। পাশে ১৫ একরের মত জলকরে অল্প পানি আছে। এলজিইডি অফিস ‘সারাদেশে পুকুর,খাল উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় কুমার নদীর শাখা খাল পুন:খনন ও খালের ঘাটে ঘাটলা নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। খননের জন্য কাজটি পায় মিরপুর উপজেলা আমলা সদরপুর ইউনিয়নের মিটন পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা ঠিকাদার রওশন আলী। কাজের মেয়াদ ছিল ২৭ জানুুয়ারি ২০২০ থেকে ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নদীর পাশে একটি বাগানের মধ্যে মাটির তোলার যন্ত্র (ভেকু মেশিন) পড়ে আছে। জুন মাসের পর ঠিকাদার লোকজন পাঠিয়ে কয়েকদিন নদীর একটি অংশে সামান্য কিছু মাটি তুলে চলে গেছে। সদ্য মাটি তোলা হয়েছে সেখানে। আর বিগত তিন বছর ধরে সব মিলিয়ে এক মাসের মত খনন কাজ করেছে ঠিকাদার রওশন। এতদিনে শুধু ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে নদীর পাড়ে। টানা ৪ বছর খননের পরও নদীতে পানি না থাকার বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ জেলেরা। পানি না থাকার বিষয়টি জানতে চাইলে জেলেরা বলেন,‘ হঠাৎ করে ২০২০ সালে নদী খনন করা হবে বলে ঠিকাদার ভেকু মেশিন নিয়ে আসে। তখন নদীতে পানি ও মাছ ছিল। শীতের মধ্যে নদীর একটি অংশের মাথায় বাঁধ দিয়ে সব পানি ছেঁকে ফেলে দেয়। এরপর পানি শুন্য হয় নদী। নদীর এক পাশ থেকে খনন না করে শুধু পাশ থেকে মাটি তুলে পাড় তৈরি করা হয়েছে। এতে নদী এখন সমতল নেই। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। এ কারণে পানি দাঁড়াতে পারে না। মৎস্যজীবী শামীম আল হাসান বলেন,‘নদীতে আমরা মাছ চাষ করি। ঠিকাদার ও এলজিইডির প্রকৌশলীরা আমাদের পরামর্শ না নিয়ে ইচ্ছামত কোন রকমে কাজ করেছে। কোন খননই হয়নি। ৪টি বছর আমাদের হয়রানি করেছে তারা। তাদের গাফিলতির কারণে আমরা এখন সর্বশান্ত হওয়ার পথে। স্থানীয়রা বলেন, তিন বছর আগে পানি ছিল। একদিকে কম বৃষ্টি হওয়ায় ও খনন কাজ ঠিকমত না হওয়ায় পানি দাঁড়াতে পারছে না। গরু-ছাগলের গোসল করাবে এমন পানি নেই। খুবই সমস্যা হচ্ছে এলাকার মানুষের।’ ছানোয়ার হোসেন ও জাকির হোসেন নামের দুই ব্যক্তি জানান,‘বৈশাখের আগে আমরা ১৭ লাখ টাকা ইজারা নিয়েছি। ২ লাখ টাকার বেশি জামানত পড়ে আছে। এখন বড় অংশে কোন পানি নেই। মাছ চাষতো দুরে থাক গোসল করার মত পানি নেই। ৬০ লাখ টাকার খননে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে কিছু বলার নেই। সব টাকা প্রকৌশলী আর ঠিকাদার ভাগাভাগি করে নিয়েছে।’ নদীতে পানি থাকায় পাড়ে নৌকা পড়ে আছে। সেখানে ঘুন ধরেছে। পচে যাচ্ছে নৌকার অংশ। জাল ফেলে রাখা হয়েছে পাড়ে। ছেলেরা ধার-দেনা করে অর্থ নিয়ে নদী ইজারা নিয়ে এখন বিপাকে বলে জানান মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন মোল্লা। তিনি বলেন,এলজিইডির এই প্রকল্পে আমরা সর্বশান্ত। তাদের খনন হয়েছে ইচ্ছেমত। কোন পরিকল্পনা ছিল। বারবার প্রকৌশলীদের ফোন দিলেও তারা এসে ঠিকাদারের কথা শুনেছে, আমাদের কোন কথা রাখেনি। দুই বিঘার বেশি জমি বিক্রি করে নদী ইজারা নিয়েছি। এখন পথে বসা ছাড়া কোন উপায়। সরকার যদি আমাদের অর্থ মওকুফ করে দেয় সেই দাবি করছি। এখই সাথে নদী খননের অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ স্থানীয়রা জানান,‘ ৪ বছর ধরে ঠিকাদার কি করছে সেটা এলাকাবাসী জানে না। তারা আসে যায় খনন হয় না। শুনেছি চলতি বছরের জুনে কাজ শেষ দেখিয়ে সকল অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার রওশন আলী বলেন,‘২০২০ সালে কাজের মেয়াদ শেষ লেখা থাকলেও পরে তা বাড়ানো হয়। চলতি বছর কাজ চুড়ান্ত শেষ হয়েছে। কি পরিমান মাটি উত্তোলন করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনে নেই। জেলেদের অভিযোগ নিয়ে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি।’ এদিকে এ কাজের জন্য সকল বিল উত্তোলন করা হয়েছে বলে এলজিইডির একটি সুত্র জানিয়েছে। নদী খননের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকায় একজন সহকারি প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীর যোগসাজসে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে মিরপুর উপজেলা এলজিইডি অফিসে গেলে কথা বলতে রাজি হননি উপজেলা প্রকৌশলী রোশান আহমেদ। তিনি এক উপ-সহকারি প্রকৌশলীকে দেখিয়ে দেন কথা বলার জন্য। ওই উপ-সহকারি প্রকৌশলী সংবাদ না প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ জানান। আর মালিহাদ ইউপি চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন বলেন,‘জলকরে কোন পানি নেই। ঠিকাদারের অনিয়মে খনন কাজ ঠিক মত হয়নি। ৪টি বছর ধরে ঠিকাদার অনিয়মের মধ্যে দিয়ে কাজ করলেও এলজিইডি কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এখন মৎস্যজীবী সমিতির জেলের কষ্টে দিন পার করছে। বিষয়টি দেখা প্রয়োজন।’
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL