নিজস্ব প্রতিনিধি
এম.এইচ.রুবেল, ঝিনাইদহ :
এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ বলে খ্যাত সুইতলা মল্লিকপুরে রয়েছে এক প্রাচীনতম বটগাছ। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহর হতে পূর্বে ৮ নং মালিঘাট ইউনিয়নের বেথলী মৌজায় এই বটগাছের অবস্থান। বর্তমানে ১১ একর জমি জুড়ে রয়েছে এর অস্তিত্ব। এর উচ্চতা আনুমানিক ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। বর্তমানে বটগাছটি খন্ডখন্ড হয়ে ৫২ টি বট গাছে রূপ নিয়েছে।
বিবিসির জরিপে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম খ্যাত এই বটগাছের অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জটিলতা এবং কিংবদন্তী। কারো কাছে সুইতলার বটগাছ, কারো কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ আবার কারো কাছে বেথলী বটগাছ বলে এটি পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে এর অবস্থান বেথুলী মৌজায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
প্রায় দু’শ বছর আগের এই গাছের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানা না গেলেও এলাকার বয়োবৃদ্ধদের মুখে জানা যায়, একটি কুয়ার পাড়ে ছিল এই গাছের মূল অংশ। তখন জনবসতি ছিল খুবই কম। রাস্তার এই গাছটি ছিল ডাল-পালা পাতায় পরিপূর্ণ। গাছের নিচে রোদ বৃষ্টি পড়তো না। মাঘ মাসের শীতের রাতেও গাছের তলায় গরম লাগতো। গরম কালে গাছের নিচে ঠান্ডা লাগতো। পথিকরা গাছের তলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত।
বাস্তবে এই এলাকায় সুইতলা নামক কোন স্থানের অস্তিত্ব নেই তাই বয়োবৃদ্ধদের ধারণা পথশ্রান্ত পথিকরা যখন এই মনোরম স্থানে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিত, তখন থেকেই অনেকের কাছে এটি সুইতলা বটগাছ বলে পরিচিতি লাভ করে। আর এর থেকেই নামকরণ হয় সুইতলা বটগাছ। কারো কাছে এর অবস্থান বেথুলী মৌজায় তাই বেথুলী বটগাছ হিসাবে এর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। পথশ্রান্ত লোকজন বটগাছের নিচে বসে বিশ্রাম করত, সময় কাটাতো। এ জন্য মল্লিকপুর গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি বটগাছের পাশে দোকান বসিয়ে ব্যবস্যা শুরু করে। মল্লিকপুরের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কেন্দ্রর নামেই মল্লিকপুরের বটগাছ হিসাবে এটি পরিচিত লাভ করেছে।
এই বটগাছের জন্ম যে কুয়ার পাড়ে সেই কুয়া কবে কখন কে খনন করেছিলেন তার সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি। মল্লিকপুর গ্রামের অনেকেই জানান, যে জায়গায় কুয়া ছিল ওই জায়গায়টি সিএস রেকর্ডের পূর্বে বেথলী গ্রামের শ্রী ভূষন সাহাদের পরিবারের কারো নামে ছিল। বর্তমানে পুরোটাই সরকারের খাস জমির অন্তুর্ভূক্ত হয়েছে। কুয়ার পাড়ের সেই বটগাছটি কালক্রমে বোয়া নেমে পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহ দখল করে নিয়েছে। মূল গাছ এখন আর নেই। কোথায় ছিল তার সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারে না। বর্তমানে প্রায় ২/৩’শ বোয়া নেমে প্রায় ১১ একর জমি দখল করে নিয়েছে এই বৃহত্তম গাছটি। বট গাছটি কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেথুলী বা মল্লিকপুরের বাজার।
এই বাজারের প্রথম দোকানদার ছিলেন মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত আলী, বেথুলী গ্রামের স্বরজিত কুমার সাহা, মমতাজ ডাক্তার মলিলকপুরের মুনছুর বিশ্বাস, মথুরাপুরের হামিদুল। দুর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে এখানে কেনা-বেচা করতে আসে। পাখিদের কিচির মিচির শব্দ লেগেই থাকে। বটতলায় কালীপূজার জন্য একটি স্থায়ী পিড়ি তৈরী করা হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌর পদ অধিকারী এবং হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এটি নির্মিত হয়।
এলাকাবাসী জানিয়েছে অযত্ন অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নানামুখী অত্যাচারের কারণে এই ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ নষ্ট হতে চলেছে। মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত মিয়া জীবিত থাকা পর্যন্ত তিনি এসব দেখাশুনা করতেন। তিনি নিজ সন্তানের মত ভালবাসতেন এই বটবৃক্ষকে। যেকারণে তিনি এই বটগাছের কাছে সর্বপ্রথম দোকান দেন এবং বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।
স্থানীয়রা আরো জানান ১৯৮২ সালের পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছ বলে পরিচিতি ছিল কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের একটি গাছ। পরবর্তীতে বিবিসির এক তথ্যানুষ্ঠান প্রতিবেদনে প্রচার হয়। কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজার সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছই এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ। ১৯৯৮ সালের দিকে কালীগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র রায় এর সহযোগীতায় সেখানে একটি ফুলের বাগান তৈরী করা হয়। বটগাছের চারপাশ ঘিরে প্রাচীর নির্মাণের ব্যবস্থাও করেন তিনি।
এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তর বটগাছের ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে অনেক স্থান থেকে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীরা আসেন। এর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ১৯৯০ সালেই বটগাছের পাশেই প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রেষ্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়। এর জন্য মল্লিকপুরের মৃত জহর আলীর স্ত্রী মোছাঃ কুন্টি বিবি ৩২ শতক জমি জেলা পরিষদের নামে দানপত্র দলিল লিখে দেন। ইতিহাস খ্যাত এই বটগাছটি সংরক্ষণ এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুললে হাজার হাজার দর্শনার্থীরা এখানে ভিড় করবে। সরকারের ঘরেও আসবে রাজস্ব।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL