পদ্মা বহুমুখী সেতুকে কেন্দ্র করে এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ স্বপ্ন দেখেছেন দিনপরিবর্তনে আগামীর নতুন দিগন্তের। শিল্পবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তরা। তারা এখন নতুন নতুন ব্যবসার পরিকল্পনাও করছেন। এছাড়া এ সেতুটি পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যেমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অঞ্চলের একুশটি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। তাদের কারো মতে শুধু এই অঞ্চলই নয়, বদলে দেবে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিকেই। তাই পদ্মা সেতু কেবল যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার নয়, বরং এটিকে ইকোনমিক করিডোর হিসাবে গড়ে তুলতে, সরকারকে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির পরমার্শ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকসহ অনেকে।
সরেজিমনে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকার গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়েছে। সেতু প্রকল্পে ভাঙ্গায় নির্মিত হয়েছে বহুমুখী ইন্টারচেঞ্জ। নির্মাণকাজ চলছে রেলওয়ে জংশনের। আর নির্মিত হবে বঙ্গবন্ধু মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র, পদ্মা সেতু জাদুঘর। এত সব নান্দনিক স্থাপনাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
আগে থেকেই বরিশাল বিভাগে তেমন কোনো শিল্প-কারখানাই নেই। তবে এ অঞ্চলের উদ্যোক্তা-প্রশাসন-জনপ্রতিনিধি-রাজনীতিকসহ সংশ্লিষ্টরা এ অঞ্চলে শিল্প বিপ্লবের সম্ভবনা দেখেছেন। বরিশাল অঞ্চল কৃষি প্রধান ছিল। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার জন্য সৃষ্টি হবে অনুকূল পরিবেশ। অনেকের কাছে ঢাকা বা আশপাশের চেয়ে বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চলে কারখানা স্থাপন লাভজনক মনে হবে। চট্টগ্রাম নয়, তাদের পছন্দের বন্দর হবে মংলা বন্দর। বেনাপোল স্থল বন্দরের গুরুত্বও বেড়ে যাবে। সেতুর কারণে শিল্প হবে, সড়ক-হাসপাতাল-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-হাউসিং প্রকল্প গ্রহণে এগিয়ে আসবেন উদ্যোক্তারা। পর্যটন সুবিধার প্রসার ঘটবে। তবে পদ্মা সেতুর কারণে এবার খুলনা শিল্প অঞ্চল জেগে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্ব অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার। বন্দরের দূরত্ব আরো বেশি। পদ্মা সেতু পথে ঢাকা থেকে মংলা বন্দরের দূরত্ব এর চেয়ে কম। সেতু পথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব কমেছে ১০০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি।
এছাড়া পদ্মা সেতু পর্যটনের নতুন সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। কেউ চাইলে ঢাকা বা আশপাশের এলাকা থেকে একদিনেই কুয়াকাটা কিংবা কুড়িয়ানার পেয়ারাবাগান-নদীর হাট-গুঠিয়া মসজিদ-বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দির এলাকা ঘুরে যেতে পারবেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এ জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালি সোপান হিসেবে কাজ করবে।
এক সময় উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধক ছিল যমুনা নদী। এ নদীর ওপর যখন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হলো, পাল্টে যেতে শুরু করল অর্থনীতির গতিপথ। সেতুর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ নানাভাবেই লাভবান হয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্যে ফিরেছে অনেকে। দেশের জন্য এ পরিবর্তন ইতিবাচক। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণ ব্যয় উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে মোট খরচ হয়েছিল ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের জুন থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ২১ বছরে সেতুর টোল আদায় থেকে টাকা এসেছে ৫ হাজার ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ২৫ বছরে সেতুতে বিনিয়োগের টাকা তুলে আনার। কিন্তু সেই টাকা উঠে এসেছে সাত বছর আগেই। যা জাতীয় অর্থনীতির সুবাতাসকেই নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ হওয়ার কারণে এ ধরনের বড় সেতু নির্মাণে দুটি লাভ হয়। সেতু নির্মাণে যে বিনিয়োগ করা হয় তা দ্রুত উঠে আসে, সঙ্গে মুনাফাও। সেতুর সঙ্গে যুক্ত অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে যেটার বাস্তবায়ন ঘটেছে।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এখন দেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। এই সেতু খুলে দেওয়ায় তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে গেল। আস্তে আস্তে পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতুর মাধ্যমে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই আগামীতে এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে।
এছাড়া পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপে মালদ্বীপের মতো পর্যটন উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগৎ তৈরি করা সম্ভব।
এ সেতু নির্মাণ হওয়ায় কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে এখন সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব। কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র ৬ ঘণ্টায়, ফলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশপাশে বেশকিছু দ্বীপের সঙ্গে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। তাহলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে। এ জন্য ইতোমধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে।
তাছাড়া পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পারে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার কথাবার্তা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। ইতোমধ্যে বেশকিছু আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এই সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্পকারখানা হবে, কোথায় কৃষি জমি হবে— সেসব ভেবেচিন্তে করতে হবে। এই সেতুকে ঘিরে আগামীতে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল মোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠবে। তবে সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, একে কেন্দ্র করে ইকোনোমিক জোন ও শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে পারলে সেটি জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে অবদান রাখতে পারবে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে ১৭টা ইকোনোমিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। এখন সেগুলো করতে হবে। তাহলে জাতীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখতে পারবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আমাদের উন্নয়নের বড় বাধা। যেমন এখনো এনবিআরের কর আদায়ে অনেক ঘাটতি আছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কিন্তু রাজস্ব আয়-জিডিপি কমছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগে বিনিয়োগ করে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ দরকার, বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি আসবে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সেতুটি চালু হওয়ায় দক্ষিণ বাংলায় শিল্পকারখানা স্থাপনে আরো বেশি করে উৎসাহী হবেন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। তাদের যেন বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি পেতে কোনো অসুবিধা না হয়, তা এখন থেকেই সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে।
তিনি বলেন, শুধু দ্রুততর যোগাযোগ, বিতরণ ও বিপণনের সুবিধার কারণে নয়, পদ্মা সেতু করিডরের উভয় পাশে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে বহুমাত্রিক প্রভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান মনে করেন পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনেতিক মুক্তির এক অনন্য প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এ সেতু হয়ে উঠবে পুরো দেশের অর্থনৈতিক করিডরের মূলকেন্দ্র এবং অপকল্পনীয় পরিবর্তন আনবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার অর্থনীতিতে।
তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবেই দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এ অঞ্চলের একুশটি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এই সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আর ঝড়-বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না।
তিনি আরো বলেন, সেতুটির কারণেই এই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে এসেছে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এই অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL