এসকে দোয়েল, পঞ্চগড় :
বিশ্বব্যাপী খুবই জনপ্রিয় পানীয়ের নাম কফি। চায়ের মতো জনপ্রিয়। দামও বেশি। বলা হয় বিশ্বের উচ্চ মূল্যের একটি ফসল কফি। সেই কফি বাণিজ্যিকভাবে আবাদের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে। চা শিল্পখ্যাত এ জেলায় কৃষিতে নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে যোগ হয়েছে কফি চাষ। সমতলে ছায়াযুক্ত মাটিতে সাথী ফসল হিসেবে আবাদ শুরু হয়েছে নতুন ফসলটি। গাছের ডালে থোকায় থোকায় ঝুলছে সবুজ, লাল ও কাঁচা হলুদ রঙের ফল। সাথী ফসল হিসেবে কফি আবাদ কৃষকদের দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন। তবে কফির প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজার নিয়ে দু:শ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে কফি ও কাজু বাদাম গবেষণা উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় শুরু হয়েছে এই কফি চাষ। জেলার তিনটি উপজেলা (পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী) ২৬ হেক্টর জমিতে কফি ও কাজু বাদাম আবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৪টি প্রদর্শনীতে ৭৪ জন চাষি আবাদ করছে এই কফি চাষ। চাষিরা কফিকে সাথী ফসল হিসেবে তারা ছায়াযুক্ত জায়গায় আবাদ করছেন। দুই বছরের মধ্যে বাগানের গাছগুলোতে ধরেছে ফল। কিছু কিছু গাছে পেকেছে ফল। অনেক গাছে আসতে শুরু করেছে ফল। আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া উপজেলার কফি গাছগুলোয় ফল চলে আসবে।
জানা যায়, পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি আবাদ হয়ে থাকে। বিশ্বের প্রধান কফি উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভারত, ইন্দেনেশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, গুয়েতেমালা প্রভৃতি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও চাষ হচ্ছে কফি। দেশে অ্যারাবিকা ও রোবস্তা নামে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি কফি চাষ হচ্ছে। এক্ষেত্রে পঞ্চগড়ের আবহাওয়া রোবস্তা কফি চাষের উপযোগী। ছায়াযুক্ত স্থান ছাড়া কফি চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ কফির চারার ওপর রোদ পড়লেই চারা নষ্ট হয়ে যায়। তবে পাঁচ বছর পর পুরোপুরি ফল আসা শুরু করলে চারাগুলো ততোদিনে রোদ-সহনশীল হয়ে যায়। এটি রুবিয়াসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় চিরসবুজ ও ছোট বৃক্ষ জাতীয় গাছ। পাতা সরল, চওড়া, গাঢ় সবুজ বর্ণের।
জেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের বিশমনি এলাকায় কফি আবাদ করছেন আবদুল হালিম প্রধান নামের এক কৃষক। তিনি বাড়ির পাশে ৩৩ শতাংশ জমিতে লাগিয়েছেন ১৩৫টি গাছ। এসব কিছু গাছে ফল ধরে পাকতে শুরু করেছে। বাকি গাছগুলোতে ফল আসতে শুরু করেছে। ফল ধরলেও দু:শ্চিন্তা বোধ করছেন হালিম প্রধান। কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি জানা না থাকায় গাছ থেকে তোলা পাকা ফল রোদে শুকাচ্ছেন।
এ চাষির বাগানে গিয়ে দেখা যায়, কফির চারাগুলো দেখতে অনেকটা দেবদারু চারার মতো। ছায়াযুক্ত জায়গায় রোপনকৃত ১৩৫টি গাছের মধ্যে বেশ কিছু গাছে লতিয়ে রয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ কফির ফল। কফির পাকা ফল টকটকে লাল, আবার কোনোটা কাঁচা হলুদের মতো। দেখতে নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করেছে। বেশ কিছু পাকা ফল তুলে রোদে শুকাতে দেখা যায় তাকে।
জেলার সদর উপজেলার কফি চাষ করছেন আরেক চাষি মুনাইম। তিনি জানান, কৃষি অফিসের সহায়তায় ২০২১ সালে এক বিঘার মতো জমিতে কফি চারা রোপন করেছিলাম। সাথী ফসল হিসেবে সুপারি বাগানে ১২৫টি গাছ রোপন করেছিলাম। কৃষি অফিস আমাকে কফির চারা, সার, কীটনাশক দিয়েছিলেন। বাড়তি কোন খরচ না হলেও সেচ বাবদে আমাকে ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। রোপনের দুই বছর হতেই বাগানের গাছগুলোতে ফল এসেছে। দুই বছরেই প্রতি গাছ থেকে ৫শ গ্রাম থেকে এক কেজির মতো ফল পাচ্ছি। আশা করছি গাছগুলো পাঁচ/ছয় বয়স হলে প্রতি গাছ থেকে ৪/৫ কেজি ফল পাব। যেহেতু নতুন লাগিয়েছি। কৃষি বিভাগ যে স্বপ্ন দেখিয়েছে। সে প্রত্যাশিত ফল এখন পাবো না। তবে আশা করছি এ থেকে আমি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আসতে পারে কফি আবাদে। কাংখিত ফলন ও বাণিজ্যিক পথ সুগম হলে সুসময়ের দুয়ার খুলে যাবে এ নতুন ফসল কফি চাষে।
তবে চাষিরা কফি গাছ লাগিয়ে ফল ফলিয়ে আনন্দিত হলেও তারা দু:শ্চিন্তা বোধ করছেন ফলটির প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাত নিয়ে। তারা জানান, যদি কফি চাষে অতিরিক্ত তেমন খরচ নেই। বিঘাতে ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। লাভই বেশি। কিন্তু রোপণের দুই বছর মধ্যে গাছগুলোতে ফল আসলেও কিভাবে এর প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাত করবো সে পদ্ধতি জানা নেই। প্রক্রিয়াকরণে তো কফি প্রসেসিংয়ের মেশিন প্রয়োজন। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে সহযোগিতা চেয়েছি।
হালিম প্রধান ও মুনাইমের মতো কফি আবাদে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে স্থানীয় চাষীদের মধ্যে। অনেকে নতুন এ ফসল দেখতে ছুটে যাচ্ছেন বাগানে। মাহফুজুর রহমান প্রধান বলেন, কফি চাষি হালিম আমার ছোট ভাই। প্রায় আড়াই-তিন বছর আগে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় কফির চারাগুলো রোপন করা হয়। এটি আবাদে বাড়তি জমি লাগে না বিধায় সুপারি বাগানে লাগানোর পর দেখছি গাছগুলোতে ফল ধরেছে। এটি দেখে আমিও আগ্রহবোধ করছি। যদি হালিম এ থেকে আয় করতে পারে আমিও আগামীতে কফি আবাদ করবো।
স্থানীয় তরুণ শোভন বলেন, আমাদের অঞ্চল তো চা শিল্প এলাকা। এখানে চা আবাদ হয়। কিন্তু এখানে যে কফি আবাদ হবে তা ধারণা ছিল না। এ কফি আবাদ ভালো একটি ভবিষ্যত হতে পারে। যদি আমরা এটি চাষে উদ্বুদ্ধ হই তাহলে আশা করায় পঞ্চগড়ে ভালো কিছু হবে। শিশু সাব্বির জানায়, আমি কখনো কফি দেখিনি। টিভিতে দেখেছি। এখন আমি বাস্তবে দেখছি কফির ফল কেমন। খুব ভালো লেগেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) শাহ আলম মিয়া বলেন, পঞ্চগড়ের আবহাওয়া কফি চাষে অনুকূল হওয়ায় এখানে কফি চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ২০২১ সালের শেষে দিকে এ জেলায় কফি ও কাজু বাদাম গবেষণা উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় কফি ও কাজু বাদাম আবাদ শুরু হয়েছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের পাশে থেকে চারা, কীটনাশক, কারিগরি প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। কফির বাজার ব্যবস্থাপনা ও ফল সংরক্ষণ বিষয়েও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, কফি চাষের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানের প্রয়োজন। কফি পরিচর্যার জন্য বাড়তি খরচ নেই। জেলার তিনটি উপজেলার মধ্যে সদরে স্বল্প পরিসরে কফি সংগ্রহ শুরু হয়েছে। কফি সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতের ক্ষেত্রে কৃষকদের সহযোগিতা করা হবে। নতুন এ ফসল কফি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষের উদ্যোগ নেয়া হবে। আশা করছি চাষিরা কফি চাষে লাভবান হবেন বলে আশা করছি।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL