২২-নভেম্বর-২০২৪
২২-নভেম্বর-২০২৪
Logo
রাজশাহী

জাতীয় অর্থনীতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে রাজশাহীতে গবাদিপশু পালন

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-২৭ ১৮:০২:০৫
...

রাজশাহী :

রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী। তার গরুর খামারে গরু রয়েছে ৬ টি। গাভি ২ টি , বকন গরু ৩ টি বকনা ১টি। দুইটি গাভি প্রতিদিন দুধ দেয় গড়ে ১৫ থেকে ২০ লিটার। বাজারে প্রতি কেজি দুধের মুল্যে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। তার সাথে কথা বলে জানা যায় দুইটি গরু থেকে মাস শেষে দুধ বেচেঁ টাকা আসে প্রায় ৩৫ হাজারের মত। গরুর খাবার এবং বাহ্যিক খরচ হয় ২০ হাজারের মত । মাস শেষে মোহাম্মদ আলীর গরুর দুধ বিক্রি থেকে আয় হয় ১৫ হাজার টাকার মত। এই বিষয়ে গরু খামারি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘একটা মাত্র গরু থেকে শুরু হয় আমার গরু লালন পালন। প্রথম প্রথম কষ্ট মনে হলেও পরবর্তীতে যখন অভ্যাস্ত হয়ে পড়ি তখন এই বিষয়টি আমার কাছে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এখন আমার খামারে গরু আছে প্রায় ৬টির মত। দুইটি গাভির দুধ বিক্রি করে আমার মাসে পনের বিশ হাজারের মত থাকে। এই নিয়ে আমার সংসার চলে যায়’।

মোহাম্মদ আলীর মতই পবা উপজেলার পুঠিয়াপাড়া এলাকার গোলজার আলীর খামারে রয়েছে ৩ টি ষাড়ঁ গরু। তার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, শখের বশেই প্রথমে বাড়িতে ১টি গরু কিনেছিলাম গত বছরের কোরবানী ঈদের তিনমাস আগে ৮৫ হাজার টাকায়। ঈদের সময় গরুটি বিক্রি করেছিলাম ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকায়। এভাবেই যখন দেখতে পেলাম আমার গরু পালন করে লাভ আসছে তখন থেকেই বাণিজ্যিক ভাবে বাড়ির পাশে পতিত জমিতে গরুর খামার দিয়েছি। এখন আমার খামারে ৩টি গর্ ুআছে। সামনে মাসে আরো ২টি গরু উঠানো ইচ্ছে আছে।

একই উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের শুভিপাড়া গ্রামের স্বামীহারা মরিয়ম বেগম। দুই ছেলে ও এক মেয়ে কে রেখে তার স্বামী আক্কাস আলী তিন বছর আগে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। তার সাথে কথা বললে জানা যায় স্বামীকে হারানোর পর ঘরে জমানো কিছু টাকা থেকে একটি ছাগল কিনে নওহাটার হাটে। আজকে তার অস্থায়ী খামারে ছাগলে সংখ্যা ৮ টি । মরিয়ম বেগম বলেন, আমরা স্বামী মারা যাওয়ার পরে দুই ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে কি করবো ভাবতে পারছিলাম না। কয়েকদিন পরে স্বামীর জমানো টাকা থেকে একটা ছাগল কিনি। বিলের ঘাস লতা পাতা খাইয়ে ছাগলটিকে পালন করি। সেখান থেকেই আমার শুরু হয় ছাগল পালন করা। ইচ্ছে আছে ছাগল বিক্রি করে একটি গরু কিনবো। এখন আল্লাহ যদি চায় তাহলে হবে।

এভাবেই মোহাম্মদ আলী, গোলজার আলীর ও মরিয়ম বেগমের মত এই উপজেলার অনেকেই পশু পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। উপজেলা প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর থেকে জানা যায় গরু,ছাগল সহ মোট পাঁচ শতাধিক খামার রয়েছে এই উপজেলায় । ঠিক তেমনি ভাবে রাজশাহীতে পূর্বের চেয়ে বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিক পদ্বতিতে গবাদিপশু পালন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। গবাদি পশু পালনে যেমন একদিক দিয়ে বেকার সমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক গবাদিপশু পালন থেকে প্রাপ্ত মুনাফা দেশের জাতীয় অর্থনীনিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

এই উপজেলার খামারিদের গবাদিপশু পালনে রাজশাহীর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল কর্তৃক প্রশিক্ষণ, জরুরী সেবা ও কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা পেয়ে এই এলাকার খামারিরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কর্তৃপক্ষের নানামুখি উদ্যোগগ্রহণ, সেবার মানোন্নয়ন ও উদ্বুদ্ধকরণের কারণে স্থানীয় সাধারণ মানুষদের মাঝে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে পশুপালন ও খামার ব্যবসায়। এলাকার স্থানীয় খামারী ও সেবাগ্রহীতাদের সাথে কথা বলেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সত্যতা জানার জন্য সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় দেড় শতাধিক খামারি ও সাধারণ মানুষ অসুস্থ গবাদিপশুর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল।

প্রতিদিন হাঁস-মুরগির টিকাদান, পশুপাখির চিকিৎসা প্রদান, উন্নত কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম ও উন্নত জাতের ঘাস চাষ সম্প্রসারণ এবং প্রশিক্ষণ সহ জরুরী সেবা প্রদান করে আসছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। পাশাপাশি গবাদিপশু পালনে উদ্বুদ্ধ করছেন যুবসমাজসহ সাধারণ মানুষকে। কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় প্রাত্যহিক ও নিয়মিত চিকিৎসা সেবার মধ্যে অন্যতম হলো পশুপাখির পেটফুলা, পেট ফাপা, হাত-পা ভাঙ্গা, জ্বর সহ অন্যান্য চিকিৎসা। এছাড়াও গরু-ছাগলের ভ্যাকসিন নিতে নিয়মিত ভীড় করেন খামারি ও সাধারণ মানুষরা।

উপজেলা প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর অফিসে সেবা নিতে আসা পারিলা ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, আগে আমি বেকার ছিলাম। উপজেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি আমার বাসায় গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে একটি ছোট গরুর খামার দেই। উপজেলার স্যারদের কাছে থেকে খামার করতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ পেয়েছি সবসময়। প্রথম দিকে দুইটি গরু দিয়ে শুরু করলেও আজকে আমার খামারে দশটি গরু রয়েছে। বছর শেষে খামার থেকে আমার লাভ আসে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার মত।
এই বিষয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডাঃ সুব্রত কুমার সরকার বলেন, প্রতিদিন উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দেড় শতাধিক খামারি ও সাধারণ মানুষ অসুস্থ গবাদিপশু নিয়ে হাসপাতালে এসে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও অসহায় ও হত-দরিদ্রদের মাঝে উন্নতজাতের গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বিতরণ এবং পুনর্বাসন ও উপকরণ সহায়তা প্রদান অব্যাহত আছে। তিনি আরো জানান, মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিকের মাধ্যমে দুর দুরান্তে গবাদিপশুর জরুরী চিকিৎসা প্রদান করা হয়। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে রোগ অনুসন্ধান কার্যক্রম, গবাদিপশু লালন পালন, টিকা প্রদান, উন্নতজাতের ঘাস চাষ, গবাদিপশুর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য উল্লেখিত দপ্তর নিয়মিত উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভা সহ গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে প্রতিটি পৌরসভায় ও ইউনিয়নে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। উপজেলায় প্রায় ছোট বড় পাঁচ শতাধিক গরুর খামার, ছয় শতাধিক ছাগল ও ভেড়ার খামার এবং পাঁচ শতাধিক হাঁস-মুরগীর খামার রয়েছে। ইদানিং অনেকেই খামার স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছেন। এরমধ্যে বেকার যুবকেরা আগ্রহী হচ্ছে এই পেশাতে। বিষয়টি একদিকে যেমন বেকারত্ব দূরীকরণে ভাল ভূমিকা রাখবে। ঠিক তেমনি ভাবে স্থানীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এমন ভাল উদ্যোগ। এই সেক্টরের যে কোন উদ্যোগতাকে খামারের সেড র্নিমাণ হতে শুরু করে খামারের ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা সম্পর্কিত যাবতীয় পরামর্শ সহ অন্যান্য প্রয়োনীয় সেবা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে দেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

প্রয়োজনের সময় ভালমানের কাঙ্খিতসেবা পাওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে গবাদিপশু ও খামার ব্যবসায়ীদের কর্মযজ্ঞ। বৃদ্ধি পেয়েছে গরু-ছাগল এর খামারসহ গরু মোটাতাজাকরন ও গাভী পালনের পরিধি। সেবারমানে আস্থা থাকার কারণে, স্থানীয় যুবসমাজের আগ্রহ বাড়ছে এই পেশাতে। আগ্রহী হচ্ছে সাধারণ মানুষরাও। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের। হ্রাস পাচ্ছে বেকারত্বের বলে মন্তব্য স্থানীয়দের। এভাবে চলতে থাকলে এই অ লের মানুষরা স্বাবলম্বী হবে; শক্তবস্থানে যাবে স্থানীয় অর্থনীতির বিষয়টিও।

গবাদিপশুর বাণিজ্যিক পালনে দেশের অর্থনীতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে ? এই প্রশ্ন করা হলে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণা ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আমাদের এই বরেন্দ্র অ লে একসময় লাইভস্টোক এবং গরুপালন হতো ব্যাপকহারে। কিন্তু মাঝখানে কিছু সময়ে এই গরু-ছাগল পালন কমে গিয়েছিল এবং বর্তমানে তা আবারো বেড়েছে। এখন গ্রামে আমরা দেখতে পাচ্ছি সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে অনেক বেকার যুবক গবাদিপশু পালনে আগ্রহ পাচ্ছে। তব্ েসরকার যদি গবাদিপশু পালনে বিভিন্ন উদ্যেগ গ্রহণ করে তাহলে প্রত্যন্ত অ লের খামারিরা উপকৃত হবে। এইক্ষেত্রে একটি সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং সাধারণ কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে’।