১৭-এপ্রিল-২০২৪
১৭-এপ্রিল-২০২৪
Logo
শিল্প ও সাহিত্য

মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২২-০৮-০৬ ১৭:১৪:১২
...

বীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘মুসলমানীর গল্প’ নামের গল্পের বর্ণনায় রাষ্ট্রশাসন, অপ্রত্যাশিত অত্যাচারের দোলায়িত দিন, অবিশ্বাস আর আশঙ্কার সঙ্গে আজকের সময়ের মিল অনেক।  এই মিলের তালিকার সঙ্গে গত দুই বছরে আরও যোগ হয়েছে বীভৎস ও ভয়ংকর এক আতঙ্ক।  নিকট-অতীতে এমন ভয়ার্ত সময়ের মাঝ দিয়ে মানুষকে যেতে হয়নি।  গত দুই বছরেরও বেশি সময় মানুষ লড়াই করছে প্রকৃতির ক্ষুদ্র এক অণুজীবের বিরুদ্ধে।  করোনা নামের ক্ষুদ্র অণুজীবের ভয়ে আমরা ঘরের দুয়ার এঁটে বসে ছিলাম।  অবস্থা এমন ছিল যে, প্রাণ নিয়েই সংশয়, মৃত্যুই শুধু স্বাভাবিক, আর সবই ছিল অস্বাভাবিক।  এখনও চলতে চলতে প্রতি পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে।  অণুজীবের আতঙ্ক কমে এলেও, সেটা যে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায়নি, তাও স্পষ্ট।  থাবার আঘাত কমে এলেও এখনও প্রাণঘাতী ভাইরাসের আতঙ্ক আমাদের ছেড়ে যায়নি।  এই গল্পের প্রথমাংশ ছিল এরকম :

‘তখন অরাজকতার চরগুলো কণ্টকিত করে রেখেছিল রাষ্ট্রশাসন, অপ্রত্যাশিত অত্যাচারের অভিঘাতে দোলায়িত হত দিনরাত্রি।  দুঃস্বপ্নের জাল জড়িয়েছিল জীবনযাত্রার সমস্ত ক্রিয়াকর্মে, গৃহস্থ কেবলই দেবতার মুখে তাকিয়ে থাকত, অপদেবতার কাল্পনিক আশঙ্কায় মানুষের মন থাকত আতঙ্কিত।  মানুষ হোক আর দেবতাই হোক কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল, কেবলই চোখের জলের দোহাই পাড়তে হত। শুভ কর্ম এবং অশুভ কর্মের পরিণামের সীমারেখা ছিল ক্ষীণ।  চলতে চলতে পদে পদে মানুষ হোঁচট খেয়ে খেয়ে পড়ত দুর্গতির মধ্যে।’ 

তবে আশ্চর্যের খবর এই, যখন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের আতঙ্কে সব থমকে গিয়েছিল, এমনকি সেই থমকানো সময় পেরিয়ে এসেও, যখন স্বাভাবিকতা তার ছন্দ খুঁজছে, তখনও থেমে নেই, থেমে ছিল না মানুষে মানুষে বিদ্বেষ, বিভেদ।  আর তাও চলেছে ধর্মের নামে, যাকে অস্বাভাবিক বলে এড়ানোরও সুযোগ নেই।  অতিমারিকালেও আমাদের দেখতে হয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনায় কুৎসিত রূপ।  ধর্মের নামে বিভেদ, মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা সমপ্রীতির দেয়ালে ফাটল ধরানোর চেষ্টা।  জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রলয় নাচন আমাদের ভীত করলেও ধর্মীয় উন্মাদনা, অন্যের মতের প্রতি রূঢ় রূপ দেখানো থেকে আমরা পিছিয়ে নেই, ছিলামও না।  প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘরের ভেতর থেকেই আমরা দাঁত-মুখ খিচিয়ে হুঙ্কার ছেড়েছি।  তবে আগে যা ছিল শুধুই সামপ্রদায়িকতা, এখন তাতে যোগ হয়েছে জঙ্গিবাদ, উগ্রতা, ধর্মান্ধতা। তফাৎ এখানেই।  হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভেতরেই জায়গা করে নিচ্ছে উগ্রতা।  ফলে সংখ্যালঘু মানুষের নির্যাতিত হওয়ার খবরও সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়।  যার ক্রমবর্ধমান হুঙ্কারে স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, সহযোগিতার সীমানায় সৃষ্টি হচ্ছে শক্ত দেয়াল।  বিভেদের পর্দা সরিয়ে মনে হয় তা ভাঙা কঠিন।  কিন্তু সেই কঠিন কাজটিই সহজ করে তুলতে পারে বিবেকী কতিপয় মানুষ।  তাদের বিবেচনাবোধের সামনে দাঁড়িয়ে বিভেদের দেয়ালেরও ভঙ্গুরতা টের পাওয়া যায়। 

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে, যখন উপমহাদেশসহ বিশ্ব পার করেছে এক কঠিন সময়, তখন ধর্মীয় বিভেদের দেয়াল ভেঙে ফেলছেন অসংখ্য হূদয়বান মানুষ, যাদের কথা উঠে এসেছিল সংবাদমাধ্যমেও।  গত বছর প্রকাশিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র থেকে দু’একটি উদাহরণ হাজির করছি।  ভারতের উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌয়ের বাসিন্দা গ্রাফিক ডিজাইনার ইমদাদ ইমান করোনাকালের শুরু থেকেই অংশ নিয়েছেন মানুষের শেষকৃত্যে।  করোনায় মৃত, যাদের আত্মীয় পরিজন নেই, আবার থাকলেও মৃতদের শেষকৃত্যে যারা নানা কারণে এগিয়ে আসতে পারছে না, তাদের সহায়তা করেছেন ইমান ও তার সঙ্গীরা।  ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টের যুগ্ম নিবন্ধনকারী (জয়েন রেজিস্ট্রার) হেম সিংহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যান।  অসুস্থতার খবর তিনি জানিয়েছিলেন বন্ধু সিরাজকে।  পরিবারের সদস্যরা সংক্রমণের ভয়ে শেষকৃত্যে অংশ নিতে রাজি না হলেও খবর পেয়ে প্রায় চারশ’ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বন্ধুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন সিরাজ। 

অন্য একটি বিবরণ থেকে জানা যায়, বিহারের গয়া জেলায় করোনায় আক্রান্ত এক নারীর মৃতদেহ গাড়িতেই পড়ে ছিল দুপুর থেকে রাত অবধি।  ভয়ে পরিবারের কেউ ছোঁয়নি।  শেষে রীতি মেনে এই নারীর শেষকৃত্য করেন এলাকার একদল মুসলিম যুবক।  এসব কাজের প্রশংসা জুটেছে অনেক।  বিপদে মানুষই মানুষের পাশে থাকে।

এই উদাহরণ শুধু ভারতেই নয়, সম্প্রীতির এমন নজির রয়েছে বাংলাদেশেও।  তবে উভয় দেশের ক্ষেত্রেই আশার কথা বরাবরই, যেখানেই নির্যাতন, অপরাধ, সেখানেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মানুষ।  তাতে কাজও হয়।  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখার উদ্যোগের পেছনে বরাবরই দাঁড়ায় বিবেকবান মানুষ।  সমাজে এ ধরনের মানুষের অবস্থান ও সংখ্যা যত বাড়বে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তত বাড়বে। 

এবার আমরা পেছনে ফিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুসলমানীর গল্পের প্রধান চরিত্র হবির খাঁ, যাকে এলাকার মানুষ ‘পয়গম্বরের মতোই ভক্তি করত’ তার দিকে তাকাই।  চরিত্রটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবিকতা তথা মানবধর্মকে উন্মুক্ত রাখার আকাঙ্ক্ষায় গল্পের ভেতরে বলেছেন, ‘যারা যথার্থ মুসলমান তারা ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণকেও সম্মান করে’।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত চরিত্র হবির খাঁ সমাজ সংস্কারক নন।  কিন্তু তার উদারতার উদাহরণ টেনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষে মানুষে সম্প্রীতির ও সম্মানের ওপর জোর দিয়েছেন।  হবির খাঁ’র কাছে আশ্রয় পাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বী কমলা, যৌবনে এসে মুসলমান করিমের প্রেমে বাঁধা পড়ে হবির খাঁকে বলেছে— ‘বাবা, আমার ধর্ম নেই, আমি যাকে ভালোবাসি সেই ভাগ্যবানই আমার ধর্ম।  যে ধর্ম চিরদিন আমাকে জীবনের সব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে, অবজ্ঞার আস্তাকুঁড়ের পাশে আমাকে ফেলে রেখে দিয়েছে, সে ধর্মের মধ্যে আমি তো দেবতার প্রসন্নতা কোনোদিন দেখতে পেলুম না।  সেখানকার দেবতা আমাকে প্রতিদিন অপমানিত করেছে সে কথা আজও আমি ভুলতে পারি নে। ... যে দেবতা আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন সেই ভালোবাসার সম্মানের মধ্যে তাঁকেই আমি পুজো করি, তিনি আমরা দেবতা: তিনি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন’।  একইভাবে কমলা তার বোন সরলার বিপদে বলেছে, ‘তোর ভয় নেই।  তোর জন্য আমি তাঁর আশ্রয় নিয়ে এসেছি যিনি সকলকে আশ্রয় দেন যিনি কারও জাত বিচার করেন না’।  মুসলমানীর গল্পের ভেতর দিয়ে ‘সবার ওপরে মানুষ’, এই সত্যকেই আশ্চর্য সুন্দর ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।  যা ফুটিয়ে তুলেছে সম্পর্কের মাধুর্য। 

‘মানবসম্বন্ধের মাধুর্য’ সম্পর্কে বরাবারই সজাগ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  তিনি এই সম্বন্ধ রক্ষার গুরুত্ব অনুভব করতেন।  সেই উপলব্ধি থেকেই ভারতীয় সমাজকে চিহ্নিত করে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনের সম্বন্ধকে আমরা হূদয়ের সম্বন্ধ-দ্বারা শোধন করিয়া লইয়া তবে ব্যবহার করিতে পারি’।  মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক শুধু প্রয়োজনের খাতিরে হলে, সে সম্পর্ক ও সমাজ টেকে না।  সমাজ-সমপ্রীতি রক্ষার্থে প্রয়োজনের বাইরেও আসতে হয়, ব্যবসায়িক সম্পর্কের বাইরে এসেও হূদয়ের সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়।  হূদয়জ এই সম্পর্কই মানবসম্বন্ধের মাধুর্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূল্যবান মানবিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছেন, তার শ্রীবৃদ্ধির জন্য কাজ করেছেন।  তাই সমাজে, মানুষের সেবা করার জন্য স্বেচ্ছায় মানুষই যখন দাঁড়িয়ে যায় তার বিচার-বুদ্ধি নিয়ে, তখন অন্ধকারের বিপরীতে বিবেকী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ মনকে সজীব করে। ঈষাণ কোণ থেকে উঁকি দিতে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু উচ্চারিত ও পঠিত বাক্য, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’।