জ্বালানি তেলের ইস্যুতে হঠাৎ বাড়তে থাকা ডিমের দাম কমতে শুরু করেছে। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ডজন প্রতি ডিমের দাম ১০-১৫ টাকা কমেছে, ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৫-১০ টাকা কমেছে। ডিম আমদানির বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির বক্তব্য, বেশি দামের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা কমে যাওয়া ও বাজার মনিটরিং শুরু হওয়ার ঘোষণায় কমতে শুরু করেছে ডিমের দাম।
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বৃদ্ধির কারণে ডিম ও মুরগির চাহিদা কমে গেছে। দুদিন ধরে ব্যবসায়ীরা ডিম বিক্রি করতে পারছেন না। এই চাপের কারণে ডিমের দাম কমতে শুরু করেছে।
পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বাড়তে থাকা ফিডের দাম ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বালানি তেলের খরচ বৃদ্ধির প্রভাবে সারাদেশেই পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। এই সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে সুযোগ নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম যতটা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা তার চেয়েও বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়।
রাজধানীর হাজিপাড়া বউবাজারের ডিম বিক্রেতা সফিউল্লাহ বলেন, দাম বাড়ার পর থেকে বিক্রি কমেছে। এর ওপর এখন বাজারে ডিমের সরবরাহ বেড়েছে। ফলে পাইকারি বাজারে গত বুধবার এক রাতে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা কমেছে।
তিনি বলেন, ডিমের দাম পুরোপুরি অস্বাভাবিক ছিল। জীবনে কখনো এত দামে ডিম বিক্রি করিনি। মানুষও এত দামে খায়নি। এজন্য অনেকে ডিম খাচ্ছেন না বা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।
হাজিপাড়া বাজারের আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিম না খাওয়ার প্রচার করছেন অনেকেই। এছাড়া ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছেন- এমন নেতিবাচক প্রচারণাও ডিমের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। সেজন্য বিক্রি বেশ কম।
গাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে ডিমের পাইকারি বিক্রেতারা জানান, টাঙ্গাইল থেকে যে ডিমের গাড়ি আসে তাতে ৬০-৮০ হাজার পর্যন্ত ডিম আনা যায়। সাড়ে ৬ হাজার থেকে গাড়ি ভাড়া বেড়ে এখন ৮ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। হিসেব করে দেখা গেছে, ৬০ হাজার ডিমের একটি গাড়িতে যদি ১৫০০ টাকা ভাড়া বাড়ে তবে প্রতি ডিমের ওপর এর প্রভাব পড়ে মাত্র ২৫ পয়সা।
পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য বলছে, বর্তমানে ব্রয়লার মুরগির একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ৯.৫০ টাকা এবং প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৪০ টাকার বেশি। এর প্রধান কারণ ধারাবাহিকভাবে ফিডের দাম বৃদ্ধি।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে একটা ডিমের উৎপাদন খরচ ছিল ৬.০৫ টাকা, যা আগস্টে গিয়ে দাঁড়ায় ৭.২৬ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই খরচ আরও বেড়ে দাড়ায় ৭.৭৩ টাকা এবং চলতি মাসে এর উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ৯.৫০ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি মাস পর্যন্ত সময়ে ডিমের উৎপাদন খরচই বেড়েছে ৫৭ ভাগ।
একইভাবে বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচও। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি মাসে এসে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১০৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৪৫ টাকায় ঠেকেছে। এই সময়ে মুরগির উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৭ ভাগ ।
এদিকে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম কমলেও দেশি মুরগি কিংবা হাঁসের ডিমের দাম এখনো কমেনি। হাঁসের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা। একই সঙ্গে দেশি মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৪০ টাকা।
মালিবাগ বাজারের ডিম বিক্রেতা এমদাদুল হক বলেন, ফার্মের ডিমের দাম কমেছে। ফলে এখন এমনিতেই দুই-তিনদিনের মধ্যে দেশি হাঁস-মুরগির ডিমের দামও কমবে। ফার্মের মুরগির ডিমের দামের সঙ্গে এগুলো (দেশি মুরগি ও হাঁস) ওঠানামা করে।
এদিকে চলমান দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে তেঁজগাও ডিমের আড়তে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানে ডিমের দামের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজির প্রমাণ মিলেছে। আড়তগুলো গ্রামগঞ্জের মোকাম থেকে বাড়তি দামে ডিম কেনার কোনো রশিদ দেখাতে পারেনি। এছাড়া তারাও বাড়তি দামে ডিম বিক্রির কোনো রশিদ দেয়নি খুচরা বাজারের ক্রেতাদের।
ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হাসানুজ্জামান বলেন, ডিমের আড়তে তারা কত দামে কিনেছেন তার কোনো ক্রয়ের রশিদ নেই। তাদের বিক্রির কোনো মূল্য তালিকাও নেই। আবার যার কাছে বিক্রি করছেন তাদের কোনো রশিদও দিচ্ছেন না। সম্পূর্ণ পেপারলেস বিজনেস। এর কারণ তারা সরবরাহ ও চাহিদা দেখে নিজেদের মতো দাম নির্ধারণ করছেন। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। সেজন্য এবার সতর্কতামূলক জরিমানা করেছি। সেটা না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেবো।
সমপ্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর সঙ্গে বিপিআইসিসির উদ্যোক্তারা একটি বৈঠক করেন। এ বৈঠকে উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন, ডিমের দাম যতটুকু বাড়ার কথা তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। পাইকারী বিক্রেতারা অবস্থার সুযোগ নিয়ে বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।
এ সময় উদ্যোক্তারা সচিবকে জানান, ফিডের কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক খামারি লোকসানে পড়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এ খাতকে বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ সারাদেশের প্রান্তিক খামারিরাই ডিম ও মুরগি উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। কিন্তু তারা জিম্মি হয়ে পড়েছে সিন্ডিকেটের হাতে। এলাকাভিত্তিক পাইকারি ব্যবসায়ীরা একটা দাম নির্ধারণ করে খামারিদের থেকে ডিম ও মুরগি সংগ্রহ করে।
তবে বাংলাদেশ ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি অবশ্য বাজারে সিন্ডিকেটের অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি বলেন, আমরা তো কোম্পানির রেট এর উপর ভিত্তি করেই দাম নির্ধারণ করি। কোম্পানিগুলোই দাম বাড়ায় বলে আমাদেরও বাড়তে হয়। এখন কমিয়ে দিচ্ছে, আজকের বাজারে আমরা আড়তে ১০০ ডিম বিক্রি করেছি ৯৪০ টাকায়।
এদিকে গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের জানান, ডিমের দাম না কমলে প্রয়োজনে আমদানি করা হবে। এই কথা বলার একদিনের মধ্যেই ডিমের দাম কমতে শুরু করলো।
বিপিআইসিসির সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, এখানে হঠাৎ করেই আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। কীভাবে খামারিদের রক্ষা করা যায়, শিল্পের সংকট দূর করা যায় সেটা ঠিক করতে হবে। কারণ এমনিতেই একশ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, তারা কাটছাঁট করছে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL