ভুয়া ও মনগড়া ওয়েবিলে যাত্রীদের পকেট কাটছেন পরিবহন চালক ও কর্মচারীরা। কোনো ভিত্তি না থাকলেও রাজধানীতে বিভিন্ন পরিবহনে ওয়েবিলের নামে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। একসময় সিটিং সার্ভিস করে ওয়েবিল সিস্টেম চালু করা হয়। বর্তমানে রাজধানীতে কোনো সিটিং সার্ভিস নেই। কিন্তু সেই ওয়েবিল সিস্টেম এখনো রয়েছে।
বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে যাচ্ছেতাই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রতিদিন যাত্রী ও বাস স্টাফদের মধ্যে কথাকাটাকাটি আবার কখনো হাতাহাতি হচ্ছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে রাজধানীর প্রত্যেকটি রুটে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে বেশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে। আগে সিটিং সার্ভিসের নামে যে ভাড়া আদায় হতো সেটিই রয়েছে, কিন্তু এখন আর সেই সিটিং সার্ভিস নেই।
যাত্রীরা আরো অভিযোগ করে বলেন, বাসগুলোর ওয়েবিল সিস্টেম করেছে যা যাত্রীদের গলার কাঁটা। এ ওয়েবিলের দোহাই দিয়ে তারা ভাড়াও নির্ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে সরকার কিংবা মালিক সমিতির বেঁধে দেয়া কোনো নিয়মের তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না।
যাত্রীরা বলছেন, বাস কোম্পানিগুলো নিজেদের সুবিধায় তারা বাসে কয়জন যাত্রী আছে তার একটা সংখ্যা নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে ভাড়া জুড়ে দেয়াটা অন্যায়। অর্থাৎ নিজেরা ইচ্ছেমতো একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে চেকার বসিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে। প্রতি কিলোমিটার ভাড়ার যে সরকারি রেট তা তারা তোয়াক্কা করছে না। আবার ভাড়া বেশি নিয়ে যে সুবিধা পাচ্ছে তাও নয়। এটা শুধু নিজেদের পকেট ভারি করতেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জানা যায়, রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করে ওয়েবিল পদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সড়কে বাস মালিকরা তা অমান্য করে এখনো চালু রেখেছে ওয়েবিল। ওয়েবিলের নাম করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে বাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। মোহাম্মদপুর থেকে বিভিন্ন রুটে এখনো ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় হচ্ছে। যাত্রী ও পরিবহনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
তরঙ্গ পরিবহনের একটি বাসের কন্ডাক্টর সেলিম যাত্রীদের ডাকছিলেন বাসে চড়ার জন্য। তাকে নতুন ভাড়ার তালিকার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মালিকরা এখনো আমাদের ভাড়ার মূল্যতালিকা দেননি। তাই আগের ১০ টাকা ভাড়ার জায়গায় এখন ১৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আর সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা।
মোহাম্মদপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর চিটাগাং রোড বনশ্রীসহ বিভিন্ন রুটে আগে যে ভাড়া ছিল ১০ টাকা, এখন তা ১৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব রুটের কোনো বাসের ভেতরে নতুন ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। এদিকে তালিকা ছাড়া যাত্রীরা বেশি ভাড়া দিতে না চাইলে পরিবহনকর্মীরা তা নিচ্ছেন না। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত হচ্ছে।
রাজধানীর রামপুরা থেকে বনশ্রীর ফরায়জী হাসপাতাল মোড়ে নামার জন্য আলিফ পরিবহনে উঠেছিলেন রিপন নামের এক যাত্রী। রামপুরা ব্রিজ থেকে ফরায়জী হাসপাতালের দূরত্ব ২ কিলোমিটার বা তার কম হবে। তিনি ভাড়া দেন ১০ টাকা। এ নিয়ে বাসের সুপারভাইজারের সঙ্গে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সুপারভাইজার কিছুতেই ১৫ টাকার নিচে নেবেন না। রিপনের সঙ্গে অন্যান্য যাত্রী প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৫ টাকা ভাড়া কোন যুক্তিতে এমন প্রশ্নে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেন না। তার কথা ওয়েবিলে ভাড়া বাড়ছে। এখন ১৫ টাকা। একপর্যায়ে শুরু হয় হাতাহাতি। আলিফ বাসের সুপারভাইজার গণরোষের শিকার হন।
মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল রোডের মিডলাইন পরিবহনের কন্ডাক্টর ইয়াসিন বলেন, ভাড়া ১৫ টাকা আগে ১০ টাকা ছিল। আর নিম্নে ভাড়া ১০ টাকা। নতুন তালিকা কই এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মালিকরা দেয়নি। তাই বাসের ভেতর লাগাতে পারিনি। ভাড়া ১৫ টাকাই নেব।
এ সময় নুরুল ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, ব্যাটা মগের মুল্লুক পেয়েছিস, যাই ইচ্ছা তাই ভাড়া নিবি। তোদের মালিক-সমিতি থেকে বলেছে বুধবার থেকে চেক বা ওয়েবিল বলে কিছু নেই আর তুই চেক চেক/ওয়েবিল বলে অস্থির হয়ে যাস। আমাদের এভাবে পকেট কেটে নিচ্ছিস।
শুধু মিডলাইন পরিবহনই বিভিন্ন রুটের প্রায় যাত্রীদের এক ব্যক্তি অভিযোগ। তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহনের ভাড়ায় নৈরাজ্য চলছে।
এদিকে বুধবার রাতেও মোহাম্মদপুর থেকে বনশ্রী স্বাধীন নামে গাড়িতে দেখা গেছে চরম নৈরাজ্য। রাত ১০টার দিকে ফার্মগেট থেকে স্বাধীন গাড়িতে (২১২৬) উঠলেই কন্ডাক্টর রাজু বলেন, উঠেন উঠেন ১৫ টাকা মোহাম্মদপুর। এ সময় হালিমা নামে এক যাত্রী বলেন, এই ব্যাটা তুই ফাইজলামি পেয়েছিস। চাইলেই তুই এত ভাড়া পাবি তোর সাহস কতো? ১০ টাকার ভাড়া ১৫ টাকা?
এদিকে জ্বালানি তেলে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা রাজধানীতে চেকের অজুহাতে যা ইচ্ছা তাই ভাড়া আদায় করছে। এটা সরকারের নজরে গেলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে জানান, সরকারের নতুন তালিকা অনুযায়ী বাস ভাড়া নেওয়া হবে। আগের সিটিং সার্ভিস বাতিল করা হলো। চেক সিস্টেম বা ওয়েবিল শুধু আমাদের প্রয়োজনে থাকবে। কিন্তু সেই ওয়েবিলে কোনো ভাড়া নেওয়া হবে না, বাতিল করা হলো।
বাস মালিক সমিতির এমন সিদ্ধান্ত কয়েকবার নেয়া হলেও কার্যত কোন কাজেই আসেনি। তার কথার কথা বলেন, কাজ কিছুই হয় না।
অন্যদিকে যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেওয়ায় রাজধানীর পোস্তগোলা-দিয়াবাড়ী রুটে চলাচলকারী রাইদা পরিবহনের একটি বাসকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। রামপুরা সড়কে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত বাসটিকে এ জরিমানা করে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেতৃত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোশনুর রুবাইয়াৎ বলেন, ভাড়া তদারকিকালে রাইদা পরিবহনের একটি বাস থামানো হলে যাত্রীরা বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। দেখা যায় বাসে নতুন ভাড়ার তালিকাও প্রদর্শিত হয়নি। পরে বাসটিকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
যাত্রীরা বলছেন, বিআরটিএ’র নিয়মিত তদারকি করলে অতিরিক্ত বাস ভাড়ার নৈরাজ্য থেকে যাত্রীরা রক্ষা পাবে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL