ডুবল মন্ডল, সুবোধ সরকার, মোশাররফ হোসেন। তাদের বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার সুলতানপুরে। সবাই বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চতুর্থশ্রেণির চাকরিজীবী। ঈদের ছুটি শেষে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা আসার জন্য প্রস্তুত হন। বালিরটেক কালিগঙ্গা সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে শুকতারা সার্ভিসে উঠেন। কিন্তু ঢাকায় ফেরার তাড়া থাকার সুযোগ নিচ্ছেন বাস চালকরা। ৭৫ টাকার ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৫০ টাকা। অতিরিক্তি ভাড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে কন্ডাক্টর ও হেলপারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে হাতাহাতিও হয়েছে। গাবতলী এসে পুলিশ কন্ট্রোলকে জানান তারা। কিন্তু পুলিশ কিছুই করতে পারে নাই।
শুধু গাবতলী হরিরামপুর বাস সার্ভিস নয়। পুরো আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসগুলোতেও একই চিত্রের খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ঢাকা-পাটুরিয়া, ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা-নরসিংদীসহ বিভিন্ন আন্তঃজেলাগুলোতে চলাচলরত গণপরিবহনে ঈদে ঘরমুখী হতে এবং ঢাকায় আসতে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন রাজধানীর কর্মজীবী মানুষ।
এদিকে করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না গণপরিবহন ও নৌপথের যাত্রীরা। ঈদের আগে যেভাবে ঢাকা ছেড়েছে, ঈদ শেষে একইভাবে ঢাকা ফিরছেন তারা। অনেকে আবার ঈদের পরেও গ্রামের বাড়িতে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ঢাকায় ফিরতে দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা অনেক যাত্রী মুখে মাস্কও দেখা যায়নি।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজয়নগর উপজেলায় তেলবাহী ট্রেনের ওয়াগন লাইনচ্যুত হওয়ায় সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার সুযোগ নিচ্ছেন বিভিন্ন সড়ক পরিবহনের চালকরা। চট্টগ্রাম-ঢাকা ৫০০ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার টাকা। গাড়ির সংকট দেখিয়ে চালকরা এই সুযোগ নিচ্ছেন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী তেলবাহী ট্রেন বিজয়নগরের মুকন্দপুর-হরষপুরের মাঝামাঝি পৌঁছালে লাইনচ্যুত হয়। এ সময় কেউ হতাহত হয়নি। তবে উদ্ধার কাজ চলছে। তবে ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর এই সুযোগের ব্যবহার করে বিভিন্ন পরিবহনের মালিক ও চালকরা। এ বিষয়ে আখাউড়া রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম জানান, আপাতত সিলেটের সঙ্গে রেলযোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বগি উদ্ধার শেষে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে। তবে চার থেকে ৫ ঘণ্টার বেশি সময় লাগতে পারে।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে গিয়েছিলেন হাজারও কর্মজীবী মানুষ। ছুটি শেষে আবারো তারা কর্মস্থল ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। এ কারণে দেশের সড়ক-মহাসড়ক, নৌ-বন্দরসহ অন্যান্য টার্মিনালে রাজধানীমুখী মানুষের চাপ দেখা গেছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় টোল আদায়ে ধীরগতি হওয়ায় যানজট লেগে যায়। এছাড়া পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটগুলোতেও দেখা গেছে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। বেশিরভাগ বাসে মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় আশরাফুল নামের কুমিল্লার এক যাত্রী বলেন, করোনার আগে ঢাকা-কুমিল্লার ভাড়া ছিল ১২০-১৫০ টাকা। কিন্তু এখন ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা। সিটিং বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়ার কথা না । তারপরেও অতিরিক্ত যাত্রী দাঁড়িয়ে ঢাকায় আনা হচ্ছে। ঈদের কথা বলে ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিবাদ করলে বলে গাড়ি কম। তাই এখন এভাবে যেতে হবে।
ছিদ্দিকুর রহমান নামের খুলনার এক যাত্রী বলেন, গতকাল মঙ্গলবার থেকে অফিস খুলেছে। ঈদের পরে কোনো ছুটি নেই। তাই গতকাল ঢাকায় আসলাম। পরিবারের অন্যদের বাড়িতে রেখে এসেছি। আরো কয়েক দিন বেড়াবে। এরপর আসবে। কারণ এখন এলে যাত্রীদের যে চাপ তাতে দুর্ভোগের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে নৌ-পথের যাত্রীদের করোনা ভয় নেই। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় ফেরা অধিকাংশ লঞ্চেই ছিল কর্মজীবী মানুষের ভিড়। লঞ্চের ডেক থেকে শুরু করে কেবিন এমনকি কেবিনের সামনের গলিপথেও মানুষের চাপ দেখা গেছে। টার্মিনালের প্রতিটি পন্টুনে ছিল উপচেপড়া ভিড়। স্বাস্থ্যবিধির মানার কোনো বাধ্যকতা নেই।
ঢাকায় ফেরার তাড়া, সুযোগ নিচ্ছেন চালকরা এমন অভিযোগ করেছেন আমিনবাজারগামী আশরাফ আলী খান। তিনি বলেন, যাত্রীদের জিম্মি করে প্রকাশ্যে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে, অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিষয়টি কেমন যেন লাগছে। যাত্রীদের কথা চিন্তা করে চালকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বাড়তি ভাড়া তো আদায় করছেই, সেই সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করছে। বাড়ি থেকে ফিরে এমনিতেই মন- মেজাজ খারাপ থাকে। তার মধ্যে বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে।
আশরাফ আলী অভিযোগ করে বলেন, যাত্রীদের জিম্মি করে প্রকাশ্যে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে, অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিষয়টি কেমন যেন লাগছে। যাত্রীদের কথা চিন্তা করে চালকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বাড়তি ভাড়া তো আদায় করছেই, সেই সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করছে। বাড়ি থেকে ফিরে এমনিতেই মন- মেজাজ খারাপ থাকে। তার মধ্যে বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে।
অপরদিকে স্বপ্নে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার যানজটে ভুগছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঢাকায় ফেরা মানুষ। কেউ দিনে দিনে এসেছেন। কারো আবার ঢাকায় ফিরতে রাত হয়েছে। ঈদ শেষে ঢাকায় ফেরা লোকজনকে গ্রামে যাওয়ার সময়ের মতো পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়েতে যানজটে নাকাল হতে হয়েছে। বিশেষ করে এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায়ের পয়েন্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ঢাকায় ফেরা মানুষের। সোমবার রাতে দুর্ভোগ বেশি হলেও মঙ্গলবার কিছুটা স্বস্তিতে ফেরা গেছে বলে জানা গেছে।
আবার অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ কষ্টের কথা লিখেছেন। কেউ আবার এজন্য পদ্মা সেতু দেখতে উৎসুক মানুষের উপস্থিতিকে দায়ী করছেন। ঈদের ছুটি শেষে ১১ জুলাই থেকে ফিরতি পথের গাড়ির চাপ বাড়ার কারণে লম্বা লাইন হয়ে যায় সড়কে। দুর্ভোগে পড়া যাত্রীরা বলছেন, কোথাও কোথাও যানজট ৪-৫ কিলোমিটারও ছাড়িয়ে গেছে।
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আসাদুল্লাহিল গালিব ফেসবুকে গুগল ম্যাপে দেখানো যানজটের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, উৎসুক দর্শনার্থী না কমলে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। টোলেই কেটে গেলো পুরো এক ঘণ্টারও বেশি।
এ ব্যাপারে সড়কের জন্য দেশের কোথাও যানজট হয়নি বলে দাবি করেছেন সড়ক ও সেতু পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এবারের ঈদে সড়কের অবস্থা সারা বাংলাদেশেই ভালো ছিল। সড়কের জন্য দেশের কোথাও যানজট হয়নি। বিভিন্ন স্থানে যানজট হয়েছে ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে বলে জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে অতি প্রয়োজনে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করেও মোটরসাইকেল চলেছে। তবে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের কারণেই দুর্ঘটনা কমেছে।
যানজট যেখানে হয়েছে সেটা হয়েছে ব্যবস্থাপনার কিছু ত্রুটির কারণে। সমন্বয়ের অভাব, ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি রয়েছে। একটা রুটে প্রবলেমটা বেশি হয়েছে উত্তর জনপদ। হওয়ার কথা ছিল না, কেননা আমাদের সিক্স লেন রোড অলরেডি হয়ে গেছে- এসব কথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, এ বছর যেসব জায়গায় সড়কে ত্রুটি হয়েছে, এগুলো বিবেচনায় নিয়েই ভবিষ্যতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর এক দিনে ৪৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। পদ্মা সেতু সম্পর্কে ওবায়দুল কাদের বলেন, সেখানে কোনো গাড়ি যদি দুর্ঘটনায় পড়ে সেই গাড়িটা সরানোর জায়গা আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেতুতে সেই জায়গাটা নেই। সেখানে সামনের গুলো সরিয়ে গাড়ি সরাতে হয়। অনেকগুলো নষ্ট হয়েছিল, সেই কারণে আমরা খুবই চাপের মধ্যে ছিলাম। অনেক জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটে যার কারণে ধীরগতির মুখে ছিল গাড়ি। যে কারণে কিছু কিছু সমস্যা হয়েছে তবে সার্বিকভাবে অন্যান্য রুটে সারা দেশে ভালো ছিল।
এদিকে বাড়তি ছুটি থাকা সত্ত্বেও ভিড় এড়াতে অনেকে আগেই কর্মস্থলে ফিরছেন। তেমনই একজন সেকেন্দার। সংবাদ মাধ্যম কর্মী তিনি। ভিড় বাড়ার আশঙ্কায় বাড়তি ছুটি থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় ফিরছেন তিনি। বলেন, বাড়িতে পরিবারের সবাইকে রেখে আসলাম। কষ্ট হচ্ছে। হলে কি হবে, তাও তো যেতে হবে, তাই যাচ্ছি। ছেলেটার দিকে তাকালে মনে হয় আর না আসি। তারপর আসতেই হবে। তাই আগেই আসলাম যাতে ভিড় কম হয়।
এ বিষয়ে পাটুরিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক এজিএম মো. নাছির আহম্মেদ জানান, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা সব ফেরি পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজির হাট নৌরুটে চালাচ্ছি। লঞ্চ বন্ধ থাকায় ফেরিতে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ রয়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকামুখী যাত্রীর চাপ আরো বাড়ছে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL