দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বর্ধিত ওষুধের মূল্যে দিশাহারা হয়ে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবনযাত্রার অন্যান্য সেবা, খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয়। প্রায় সব খাতেই বাড়তি ব্যয় সামাল দেওয়ার মতো আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আয় ব্যয়ের হিসাব না মেলায় বেশির ভাগ পরিবারকে কমাতে হচ্ছে খাদ্য, বিনোদন ও অন্যান্য চাহিদা।
এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আগুনে পুড়ছে শহর থেকে গ্রাম, কমছে টাকার মানও। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের দাম শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি। যার মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে বেশি। আর ওষুধ ভেদে দাম বেড়েছে দেড় থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। তাছাড়া শুধু ওষুধ ও খাদ্যপণ্যই নয়, বেড়েছে যাতায়াত ভাড়া, খাতা-কলম সাবানসহ শিক্ষা সামগ্রী, শ্যাম্পু, রাবার, শার্পনার, ডিটারজেন্টসহ অন্যান্য পণ্য।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ওষুধসহ পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। সব মিলে এই দুই শ্রেণির মানুষ আয়ের সঙ্গে পরিবারের সব ব্যয় সামলাতে পারছে না। তাছাড়া শহরের থেকে গ্রামের মানুষ খাদ্যখাতে বেশি টাকা ব্যয় করে বলেই শহরের থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে ওষুধসহ অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যে বেশি করে পণ্য ভর্তুকি দিতে হবে। পণ্য মূল্য যেন এমন হয়, মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় বেশকিছু ওষুধের পুনঃনির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। এতে জীবন রক্ষাকারী কোনো কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। এর আগে ২০১৫ সালে কয়েকটি কম্বিনেশনের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই হিসাবে সাত বছর পরে অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ওইদিন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি অনুসরণ করে ৫৩টি ওষুধের খুচরা মূল্য অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুনঃনির্ধারিত মূল্য তালিকা দেখে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, সব ওষুধের দাম যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়নি। কারণ দেশের প্রায় শতভাগ দরিদ্র মানুষের সুস্থতা বা বেঁচে থাকা নির্ভর করে এসব ওষুধের সহজলভ্যতার ওপর।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা আলামিন হোসেন বলেন, জ্বরে আক্রান্ত ৬ মাসের শিশুর জন্য নাপা সিরাপ কিনতে এসে দেখি দাম অনেক বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগের ১৮ টাকার নাপা সিরাপের দাম হয়ে গেছে ৩০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে বাসা-বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করা আলামিনের জন্য এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। একই অবস্থা নাপা-এইসের মতো সিরাপ ও ট্যাবলেটগুলোর।
আলামিন বলেন— এমনিতে চাল, তেলের দাম আসমানে উঠেছে। এর মধ্যে ওষুধের দাম বাড়লে তো আমাদের বেঁচে থাকাটাই দায়। ভাত খাবো না ওষুধ খাবো? আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের জন্য তো এইটুকু অর্থ অনেক কিছু। বাড্ডা হেলথ কেয়ার ফার্মেসির ক্রেতা জামাল বলেন, আমার টনসিল ও গলায় ইনফেকশনের সমস্যা রয়েছে। গত কয়েকদিনে এটা অনেকটাই বেড়েছে। চিকিৎসক ফেনোক্সিমিথাইলের কোর্স সম্পন্ন করতে বলেছেন। ওষুধ কিনতে এসে দেখি আগের তুলনায় দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে এক পাতা (১০টি) ওষুধের দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৫৫ টাকা হয়ে গেছে। হঠাৎ দাম এত বেড়েছে ভাবতে পারিনি। ৮ টাকা পাতা নাপার (৫০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট) দাম রাখলো ১২ টাকা। প্রথম ভেবেছিলাম দোকানিই বেশি টাকা চাচ্ছে। পরে অন্য দোকানে জিজ্ঞেস করে দেখলাম ওষুধের দামই বেড়ে গেছে।
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ঘোষণার পর থেকেই ফার্মেসিগুলোতে এটি একটি সাধারণ চিত্রে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহূত বিভিন্ন ওষুধ কিনতে এসে প্রত্যেক ক্রেতাই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
বিভিন্ন ফার্মেসি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্যারাসিটামল, ওরস্যালাইনসহ প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহূত প্রায় সকল ওষুধে দাম শতকরা ৪০ থেকে শতাধিক হারে বাড়ানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওষুধের মূল্যনির্ধারণ কমিটি ওষুধের পুনর্নিধারিত দাম অনুমোদন করলেও সরকারিভাবে এ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। তাই এর মধ্যেই প্রাথমিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা থাকে সরকারের হাতে। ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামাল, এক্সিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময়মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণে ওষুধ উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এ ওষুধের দাম পুনর্মূল্যায়ন করে সেগুলোর নতুন দাম নির্ধারণ করার বিষয় রয়েছে। ওষুধের দাম আচমকা বাড়ানো হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। অনেকদিন ধরে দামের পুনর্মূল্যায়ন হয়নি। এ অবস্থায় কাঁচামালের দাম বাড়ানোসহ নানা কারণে বাজারে ওষুধের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো কিছু ওষুধ উৎপাদনে উৎসাহিত হচ্ছে না। সবকিছু পর্যালোচনা করেই ঔষধ প্রশাসনের দাম নিয়ন্ত্রণ কমিটির পরামর্শক্রমে সরকার এ ওষুধগুলোর দাম আপডেট করেছে।
অন্যদিকে সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে গ্রামে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন অর্থাৎ ১৭ মাস শহরের থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু তা ছাড়িয়ে গেছে। গত (২০২০-২১) অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। চলতি অর্থবছর পর পর তিন মাস গ্রামে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। যেখানে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নিচে ছিল। মার্চে শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। এ সময় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ও শহরে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। একই সময়ে গ্রামে ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া মার্চে ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ তথ্যে এমনটা বলা হয়েছে।
সিপিআইয়ের হালনাগাদ তথ্যমতে, গত বছরের জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুনে সারাদেশের ভোক্তা মূল্যসূচকের হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং শহরে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের জুনে যেসব পণ্য ও সেবা কিনতে ২৭৬ টাকা ১২ পয়সা খরচ করতে হতো, একই পণ্য ও সেবা পেতে জুনে খরচ করতে হয়েছে ২৯১ টাকা ৭০ পয়সা। আলোচ্য সময়ে খরচ বেড়েছে ১৫ টাকা ৫৮ পয়সা। এর মধ্যে গ্রামে বেড়েছে ১৫ টাকা ৯৮ পয়সা। শহরে বেড়েছে ১৪ টাকা ৯২ পয়সা। জীবনযাত্রার সূচকে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে ১ টাকা ৬ পয়সা।
এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে অধিক ব্যবহার্য এসব ওষুধের দাম বাড়ায় স্বাভাবিক জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। সরকার তার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছে, আবার সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিল। নিত্যপণের মধ্যে ওষুধের এই মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে। মানুষ একবেলা ভাত না খেলেও প্রেশারের ওষুধটা খায়। কারণ তার আগে জীবন বাঁচাতে হবে। আপনি সুস্থ না থাকলে খাবার খাবেন কি করে? খেতে হলে তো আগে সুস্থ থাকতে হবে। এজন্যই ওষুধের দোকানে মানুষ লাইন ধরে ওষুধ কিনে। অর্থাৎ আমাদের ভোগ্য পণ্যের থেকেও ওষুধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে পরিণত হয়েছে। ঔষধ প্রশাসনসহ সকলকে এ বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। দাম বাড়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু এত বেশি বাড়ানোটা কতটা যুক্তি সঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওষুধের দাম ৪০ শতাংশ থেকে শতভাগের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্নায়ের মানুষ। সব মিলে এই দুই শ্রেণির মানুষের আয়ের সঙ্গে পরিবারের সব ব্যয় সামলাতে পারছে না। প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছেন। কম করে পণ্য কিনছেন। এতে পুষ্টির অভাব হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বের করে আনতে হবে। পণ্যের দাম কমাতে সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে।
ওষুধের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে এটা ঠিক কিন্তু এত বেশি হারে বেড়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এছাড়া অনেক ওষুধের কাঁচামাল আমাদের দেশেই উৎপাদন হয়। অল্পকিছু আমরা বাইরে থেকে আমদানি করি। এন্টিবায়োটিকের থার্ড জেনারেশন পর্যন্ত আমরা রফতানি করি। তাহলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়? যেগুলোর কাঁচামাল আমাদের দেশে উৎপাদন হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে তো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, ডালারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দিতে পারে না। এগুলো খুবই টুনকো যুক্তি। দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে তাদের যুক্তি ও কাজে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।