কক্সবাজারের টেকনাফের বিচ্ছিন্ন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। ৮ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে বসবাস ১০ হাজার মানুষের। তবে প্রতি মাসে সেখানে আনাগোনা হাজারও পর্যটকের। আগে এখানকার মানুষ মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের এই দ্বীপের প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণে স্থানীয় লোকজনের উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম এখন পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটিতে পর্যটক সমাগম বাড়ায় গড়ে উঠেছে ছোটবড় শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁ। এগুলোর বর্জ্য তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ হয় গৃহস্থালি ও পর্যটকদের ফেলা বর্জ্য। আর এসব ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে চারপাশে। এই দ্বীপে বর্জ্য ফেলার জন্য আছে একটি মাত্র ডাস্টবিন।
এখানকার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর আহাম্মদ বলেন, সেন্টমার্টিন পর্যটনের জন্য উন্মোচিত হওয়ার পর থেকে বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন। এই দ্বীপে অবস্থিত শতাধিক হোটেল-মোটেলকে বারবার নির্দেশ দেয়া হয় যেন তাদের ময়লা-আবর্জনাগুলো ডাস্টবিনে ফেলে।
তিনি জানান, কেউ কেউ সেই নির্দেশনা মানলেও দেখা যায় অনেকে উদাসীন। দ্বীপের সমস্ত বর্জ্য সংগ্রহ করে বড় ডাস্টবিনে রেখে সপ্তাহ দুয়েক পরপর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়।
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, আমি নিজে থেকে আড়াই শ ভ্রাম্যমাণ (ট্রলি) ডাস্টবিন বিতরণ করেছি, যেন যেখানে-সেখানে বর্জ্য না ফেলে অন্তত একটি নির্দিষ্ট স্থানে সবাই ফেলে।
দ্বীপের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, প্রতিদিন এখানে কয়েক হাজার কেজি বর্জ্য হয়। বছরের অর্ধেক সময় এসব দ্বীপেই থেকে যায়। যে পরিমাণ বর্জ্য বের হয়, তা ধারণের ডাস্টবিন এই দ্বীপে নেই। রহমত উল্লাহ নামের আরেকজন বলেন, মাঝেমধ্যে কিছু প্লাস্টিকের বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হলেও, বছরের বেশির ভাগ সময় বর্জ্য ডাস্টবিনে খোলা আকাশের নিচে থেকে যায়। এসব গিয়ে মেশে সমুদ্রে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডে হারিয়ে যেতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ। নষ্ট হতে পারে দ্বীপের প্রকৃতি। এমনকি দূষণের কারণে মানচিত্র থেকে হারিয়েও যেতে পারে একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় সরকারের আইন আছে। কিন্তু সেটির প্রয়োগ নেই। আমরা কাগজেকলমে আইন দেখতে চাই না। একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ চাই। কারণ দ্বীপ বাঁচলে, বাঁচবে দ্বীপের মানুষ। কিছুদিন আগে সরকার ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, এসব বিধিনিষেধ নিয়মনীতির কেউ তোয়াক্কা করছে না। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও হাজারও পর্যটকের ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমণ খুবই দুঃখজনক।
সেন্টমার্টিনে গৃহস্থালি ও হোটেল-রেস্তোরাঁর এসব বর্জ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে তিনি বর্জ্য অপসারণের স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান।
কক্সবাজারভিত্তিক বেসরকারি পরিবেশ সংস্থা এনভায়রনমেন্ট পিপলসের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনেক জীববৈচিত্র্য কিন্তু ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট যে সামুদ্রিক শৈবাল, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী, বিলুপ্ত প্রবাল আছে, এসব মূল্যবান সম্পদ রক্ষায় আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রবাল দ্বীপ রক্ষায় সরকার বিভিন্ন সময় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এসব বিধিনিষেধ কেউ মানে না। এখানে সৈকতে প্লাস্টিকের বোতল, গ্লাস, ছেঁড়া স্যান্ডেল, ডাব-নারিকেলের খোসা, বিভিন্ন পণ্যের প্যাকেট ফেলা হয়। কোনো বিধিমালা বা আইন প্রয়োগ করেও এটি রোধ করা সম্ভব নয়। নিজে নিজে সচেতন হলে দ্বীপের পরিবেশ দূষণ রোধ হবে।
ইউপি চেয়ারম্যান নূর বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে বেশ কয়েকবার প্রস্তাব দিয়েছি, একটা ফান্ডের আবেদনও করেছিলাম। এটি যেহেতু বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ, ময়লা আবর্জনা দিন দিন দ্বীপটিকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাই বর্জ্যগুলো যাতে সংগ্রহ করে টেকনাফ নিয়ে যাওয়া হয় অথবা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। কোনো সাড়া পাইনি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইইউএনও) পারভেজ চৌধুরী জানান, দ্বীপের পরিবেশ দূষণ রোধে স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। শিগগিরই এর কাজ শুরু হবে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও ইন্টারন্যাশনাল অরগনাইজেশন (এইওএম) নামের একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের নির্দেশনা মতে, ফিজিক্যালি গিয়ে ১১ মার্চ সেন্টমার্টিনে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে প্লাস্টিক বর্জ্য ও গৃহস্থালী বর্জ্য যাতে আলাদা করে ফেলা হয় তা ব্যবস্থা করব। তিনি জানান, প্লাস্টিক বর্জ্য যেহেতু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর, সেহেতু আগে প্লাস্টিক পণ্য রিসাইক্লিংয়ের জন্য একটি জায়গা নির্ধারণ করে স্থায়ী ব্যবস্থাপনার কাজ চলছে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL