কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলেও হাত বদলেই সবজির দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ

নিজস্ব প্রতিনিধি

রংপুর ব্যুরো :
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে সবজির ব্যাপক ফলন হলেও সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলেও মাত্র কয়েক হাত বদলেই সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। অথচ বাজারে ভোক্তারা সবজি ক্রয় করতে হিমশিম খাচ্ছে। মূলত লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। এমন অবস্থায় কৃষকরা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায্যমূল্য দাবি করেন।

রংপুর অঞ্চলে কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা নামমাত্র মূল্যে সবজি ক্রয় করে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন। পাইকাররা যেসব সবজি ২০ থেকে ৩৫ টাকা দরে ক্রয় করে তা ঢাকায় বিক্রয় করা হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। মধ্যস্বত্বভোগীর সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ঠকছেন। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, সরাসরি মহাজনদের কাছে দরদাম করে সবজি বিক্রয়ের কোনো সুযোগ নেই। শুধু হাত বদল করেই লাভ করছেন পাইকাররা।

বাজার থেকে ভোক্তাদের সেই সবজি ক্রয় করতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে। রংপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় মুলা, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, শিম, গাজর, করলাসহ বিভিন্ন শীতকালীন সবজিতে ভরে গেছে। কৃষকগণ সবজি তুলতে ও পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের যেন দম ফেলারও সময় নেই। কৃষক, পাইকার, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে যা জানা যায়, মাঠ থেকে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি মুলা দুই থেকে তিন টাকা, পাইকারি পাঁচ থেকে সাত টাকা, ভোক্তা পর্যায়ে ২০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।

পাতা কপি কৃষক পর্যায়ে ১০ টাকা, পাইকারি ১৫ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ২৫ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। ফুলকপি কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকা, পাইকারি ৩০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৪০ টাকায় বিক্রয় করা হচ্ছে। কাঁচা পেঁয়াজ কৃষক পর্যায়ে ৫০ টাকা, পাইকারি ৬০ থেকে ৬৫ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রয় করা হচ্ছে। কাঁচা মরিচ কৃষক পর্যায়ে ৪০ টাকা, পাইকারি ৫০ টাকা, ভোক্তা পর্যায়ে ৬০ টাকা। ঢোপা বেগুন কৃষক পর্যায়ে ৪৫ টাকা, পাইকারি ৬০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৮০ টাকা। চিকন বেগুন কৃষক পর্যায়ে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, পাইকারি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। টমেটো কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকা, পাইকারি ৩০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। গাজর কৃষক পর্যায়ে ১৫ টাকা, পাইকারি ২০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৩০ টাকা।

শিম কৃষক পর্যায়ে ২৫ টাকা পাইকারি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রয় করা হচ্ছে। মিঠাপুকুর উপজেলার রূপসী গ্রামের কৃষক আতাউর রহমান বলেন, এবার পাঁচ বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ করেছেন। জমি তৈরিসহ বীজ, সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য খরচ হয়েছে বিঘা প্রতি প্রায় ২০ হাজার টাকা। ক্ষেত থেকে যে দামে পাইকাররা ক্রয় করে নিয়ে যান, তার দ্বিগুণ দামে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয় করেন তারা।

এতে আমরাও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আবার ভোক্তারা চড়া দামে সবজি ক্রয় করছে। রানীপুকুর এলাকার কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, পাইকাররা তাদের কাছ থেকে প্রতিটি লাউ ক্রয় করে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। আর বাজারে গিয়ে সেই লাউ বিক্রয় হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। আমরা অনেক সময় নিজেই উৎপাদিত সবজি নিয়ে বাজারের আড়তে নিয়ে যাই। সেখানেও একই অবস্থা। অথচ মধ্যস্বত্বভোগীরা ২০ টাকায় সবজি ক্রয় করে নিয়ে গিয়ে ৫০ টাকায় বিক্রয় করছেন। রংপুরে উৎপাদিত সবজি প্রতিদিন ট্রাকযোগে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নানা অজুহাতে পাইকারদের কারসাজিতে কৃষকরা সবজির আশানুরূপ দাম পাচ্ছে না।

রংপুর জেলার মধ্যে মিঠাপুকুর উপজেলা সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এরপরেই রয়েছে গংগাচড়া উপজেলা। তবে সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় এবং স্থানীয় বাজার ব্যবস্থার অভাবে ন্যায্যমূল্য থেকে বেশির ভাগ সময় বঞ্চিত থাকে কৃষকরা। আর লাভ ঘরে তোলেন পাইকাররা। রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ পরিচালক (শস্য) আনোয়ার হোসেন বলেন, সবজি পচনশীল পণ্য। সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় ক্ষেত থেকে উত্তোলন করেই বিক্রয় করতে হয়। এ কারণে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়।

আমরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রংপুরের উপ-পরিচালক বোরহান উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অসঙ্গতি পেলে জরিমানা করা হচ্ছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কারণে ব্যবসায়ীরা এখন আর ইচ্ছামতো দাম নিতে পারছেন না।

আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রংপুর জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিং করছি। মজুত স¤পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে যাচ্ছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।