আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ জ¦ালানি। রান্না-বান্না, শিল্প-কারখানা ও গণপরিবহন পরিচালনায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে আমাদের অর্থনীতিতে গ্যাস নির্ভরতা বেড়েছে। বেশ কিছদিন ধরে আর এই গ্যাসে নিয়ে চলছে সংকট। এমন দীর্ঘ সংকট আগে কখনোই ছিল না।
দৈনিক দিনপরিবর্তনে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে সরবরাহ করা হয় ৩০০ কোটি ঘনফুট। মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেটর এনার্জির ভাসমান টার্মিনাল থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকায় তা নেমে এসেছে ২৫৯ ঘনফুটে।
এর মধ্যে আবার গ্যাসের বড় একটা অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বিদ্যুৎ উদপাদনে ব্যয় হয় ৪০ শতাংশ। গ্যাস উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় এখন ব্যবহার হচ্ছে ৩৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে গ্যাসের উৎপাদন কম হওয়ায় এবং ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করছে।
রাজধানীর নাগরিকদের রান্নার প্রধান জ¦ালানি গ্যাস। প্রতিদিনই সকাল ৭টার পর চুলায় গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। চুলা হয়ে যায় নিভু নিভু। অনেকের রান্না মাঝ পথে থেমে যায়। এ অবস্থা চলে প্রায় সারাদিন। মধ্য দুপুরের পর গ্যাসের চাপ কিছুটা আসে। স্বাভাবিক মাত্রায় গ্যাস আসতে হয়ে যায় গভীর রাত। এখন ২৪ ঘণ্টায় ১২ ঘণ্টা গ্যাস পাওয়া যায় না। ২০১৬ সালে দেশে প্রায় ২০ লাখ আবাসিক গ্যাসসংযোগ ছিল। এখন আরো বেড়েছে। সবাই ভুগছে জ¦ালানি গ্যাসের জটিলতায়। এসব গ্রাহককে মাস শেষে কিন্তু চুক্তির বিল ঠিকই দিতে হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় সময় গ্যাস মেলে না। এতো গেল রান্না-বান্নার কথা।
দেশের কিছু গণপরিবহন গ্যাসনির্ভর। কয়েক বছর আগে অনেক যানবাহন সিএনজি গ্যাসচালিত করা হয়েছে। বাস, কার, ট্রাক, অটোরিকশা জ¦ালানি হিসেবে গ্যাস নিচ্ছে। এসব যানবাহন সঠিক সময়ে গ্যাস না পেলে কর্মমুখী মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। আর এর চাপ পড়ে গিয়ে অর্থনীতিতে।
সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো থেকে যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে স্টেশনগুলো প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবারহ করতে পারছে না। ফলে যানবাহনগুলোকে লম্বা সময় ধরে অপেক্ষার সারিতে প্রহর গুনতে হচ্ছে।
অনেকে যানবাহন চলাচল সীমিত করে দিচ্ছে। এতে প্রভাব পড়ছে অর্থনীতির আরেক অঙ্গ যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর।
শীতে এমনিতেই গ্যাস সরবরাহে সংকট তৈরি হয়। তার ওপর উৎপাদন ঘাটতির কারণে প্রকট হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা। দিনপরিবর্তনের সংবাদ ভাষ্য মতে, নারায়ণগঞ্জে ৭০ শতাংশ গার্মেন্টস কারখানা গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে পোশাক খাতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে প্রতিযোগিতার বৈশি^ক বাজারে।
বছর পাঁচেক আগে থেকে গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলোও গ্যাসসংকটে পড়েছে। তখন গ্যাসের সংকট বিবেচনায় নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আশপাশে শিল্প-কারখানায় এবং ঢাকা, জয়দেবপুর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, কালিয়াকৈর, আশুগঞ্জ, মনোহরদি, চন্দ্রা ও সাভারসহ আশপাশের এলাকায়, গ্যাসের চাপ বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের দিকে ব্রাহ্মবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে দুটি কম্প্রেসার বসানো হয়। কম্প্রেসার বসানোর পরও তখন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও আশুগঞ্জ এলাকায় শিল্প-কারখানা স্বাভাবিক চাপ পাচ্ছিল না। তখন অধিকাংশ সময় বন্ধ থঠশতো এসব এলাকার কারখানার বয়লার।
সাভার, গাজীপুর, কোনাবাড়ী ও সফিপুর এলাকার পোশাক-কারখানা রয়েছে কয়েক হাজারের মতো। নারায়ণগঞ্জে রয়েছে দেড় হাজারের বেশি। এসব কারখানায় ডায়িং, ওয়াশিং ও আয়রনিংয়ের কাজে বয়লার চালু রাখতে হয়।
পোশাকশিল্পে গ্যাসের ব্যবহার যে খুবই প্রয়োজনীয় এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।। গ্যাস ছাড়া পোশাক শিল্প বলতে হবে অচল। সরবরাহ লাইনে যদি গ্যাস সংকট অব্যাহত থাকে তাহলে পোশাক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এবং ঠিক সময়ে শিপমেন্ট ধরানো খুবই দুরূহ।
আমাদের পোশাকশিল্প পুরোপুরি রপ্তানি-নির্ভর। অনেক আগেই এখাতে দেশ বিশ^খ্যাতি অর্জন করেছে। বিশে^র পোশাক রপ্তানিতে দি¦তীয় হওয়ার গর্ব আমাদের রয়েছে অনেকে আগে থেকে। শুধু তাই নয়। আমাদের পোশাকশিল্পে সিংহভাগই নারী কর্মী দ্বারা পরিচালিত: যা গ্রামীণ অর্থনীতির গভীরে প্রভাব ফেলে। সেই পোশাক শিল্প যদি গ্যাস সংকটের গভীর আবর্তে ঘুরপাক খায় তাহলে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ক্রমেই গভীর হবে।
শীতে গ্যাসের চাহিদা গরম কালের চেয়ে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ কোটি ঘনফুট বাড়ে। এখন গ্যাস উৎপাদন চাহিদার বিপরীতে কম থাকার পরও শীতের কারণে বাড়তি চাহিদা রয়েছে।
দেশের পূর্বাঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদিত গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় ট্রান্সমিশন কোম্পানির ম্যানিফোল্ড স্টেশনে। এখান থেকে পাইপলাইনে তা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। গ্যাস উত্তোলনের পর উচ্চ চাপে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সরবরাহ লাইনের দূরত্ব অনুসারে ধীরে ধীরে এ চাপ কমতে থাকে। এ চাপ কমার ফলে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে।
গ্যাসের চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৬ সালে আশুগঞ্জ ও এলেঙ্গায় দুটি গ্যাস কম্প্রেসার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই সময় থেকেই কম্প্রেসার স্থাপনের কাজ শুরু করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি জিটিসিএল। পরে ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর কোরিয়ার হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির মধ্যে চুক্তি করে জিটিসিএল। ২০১৪ সালে কম্প্রেসার স্থাপনের কাজ শেষ হয়। বলা যায়, তখন কম্প্রেসার স্থাপনের সাফল্য গ্রাহকরা পুরোপুরি পায়নি। এবারও হয়তো তাই হয়েছে। প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে হয়তো প্রকল্প ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও গ্যাস সরবরাহে সন্তোষজনক কার্যকারিতা আসেনি।
গ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ জ¦ালানি উপাদান। এর সঙ্গে শিল্প উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক। আর এ সম্পর্ক ঠেকেছে গিয়ে জাতীয় অর্থনীতির প্রবাহে। গ্যাসের চাহিদা, ঘাটতি, সমস্যা ও সমাধানের পথ সবই সংশ্লিষ্টদের জানা। তারপরও কেন এই স্থবিরতা? এই গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনায় অবহেলা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
গ্রাহকরা চাই আগের মতো সুষ্ঠু উৎপাদন ও নিরবচ্ছিন্ন বিতরণ। সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে সরকারকেই এসব চিহ্নিত সমস্যার সমাধান করতে হবে। জ¦ালানির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত সংকটের আর্বতে ঘুরপাক খাবে- এটা হতে পারে না। সরকারের দায়িত্ব এ জটিলতার উত্তরণ ঘটানো। গ্যাস সংকট যত তাড়াতাড়ি দূর হবে ততই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL