০২-এপ্রিল-২০২৫
০২-এপ্রিল-২০২৫
Logo
কলাম

রাষ্ট্রভাষা : আমাদের হৃদয়ে ফেব্রুয়ারি

রহমান মৃধা
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০৩-০১ ১৯:৫১:০৫
...

ফেব্রুয়ারি মাস অন্যান্য মাসের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে শহীদের রক্তে রুখে দাঁড়ানো এবং প্রতিবাদমুখর হওয়ার মাস। সব মিলে হৃদয়ে তৈরি হয় প্রতি বছরই ভালোবাসার ঢেউ। এবারও হয়েছিল কিন্তু লেখার মাধ্যমে সঠিকভাবে মাসটিকে উপস্থাপন করতে পারিনি। পুরো দেশের গণমাধ্যম ছিল সুগার ড্যাডি এবং বইমেলার রং তামাশা নিয়ে ব্যস্ত, তাই একটু বিলম্ব হয়ে গেল আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু লিখতে। তবে হৃদয়ে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি! যদিও ভাষা নিয়ে অনেক কথা লেখার আছে এবং সরাসরি বাংলা একাডেমিকে উদ্দেশ্য করে লিখলে ঠিক হবে না। কারণ জাতি হিসেবে আমাদের মতামতটা কী? সেটা আগে জানা দরকার। সেক্ষেত্রে আমি কিছু মন্তব্য তুলে ধরবো এখানে। যেমন: রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষায় পার্থক্য কী? আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, কিন্তু দাপ্তরিক ভাষা কোনটি? আমি থাকি সুইডেনে, এখানে সবকিছু সুইডিশ ভাষায় চলে অথচ বাংলাদেশে কেন সেটা সম্ভব না? নাকি আমরা যেমন আছি তেমন থাকতে চাই! আমরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি কিন্তু কোন ভাষা? মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা নাকি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার ভাষা? আমি অতীতে লিখেছি, যেমন ২১শে ফেব্রুয়ারি, শহীদ মিনার, পুষ্পার্পণ- এর সবগুলোই কিন্তু বিদেশি শব্দ (ইংরেজি, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত)। এই শব্দগুলোকে বাংলা ভাষায় মেনে নিয়েছি আমরা সবাই, এমনকি যে প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা ভাষার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন (বাংলা একাডেমি) সেই বাংলা অ্যাকাডেমির ‘একাডেমি’ আবার ইংরেজি শব্দ। এরকম হাজারও বিদেশি শব্দের সমন্বয়ে বাংলা ভাষা। যার ফলে আমরা সবাই-ই কমবেশি বাংলার সঙ্গে অন্য ভাষা মিশিয়ে কথা বলি এবং লিখি।

দেশ স্বাধীনের আগে যতটা বাংলার ব্যবহার করেছি, দেশ স্বাধীনের পরে কিছুটা কমেছে এবং যুক্ত হয়েছে বেশি বেশি আরবি এবং ফারসি শব্দ। কারণ প্রায় ৭০ লাখ মানুষ আরব দেশে কর্মরত। সেক্ষেত্রে ইদানীং বেশি বেশি আরবি, ফরাসি ব্যবহৃত হয়, তাছাড়া অনেকের ধারণা পশ্চিমবাংলায় বাংলা চর্চা হয় এবং তাদের বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়; বিধায় বাংলাকে বাদ দিয়ে যত খুশি অন্যান্য ভাষা ব্যবহৃত হওয়াটা অনেকের কাছে তেমন কোনো বিষয় না এখন। কই দেশের ভাষার প্রতি যদি সত্যিই এত দরদ তাহলে ১৯৫২ সালের সেই শহীদ ভাইদের মতো করে কেন আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছি না? আমাদের সেই সব ভালোবাসা আস্তে আস্তে বিলীন হতে চলেছে। মন বলে শোষণ, শাসন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সোচ্চার হই আর ঝাঁপিয়ে পড়ি কিন্তু না তা করব না, কারণ আমরা শান্তিপ্রিয় শান্ত জনগণ। আমরা এখন ভিতু হয়ে গেছি, প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি আর অপমান সইতে শিখেছি। নীতিহীন এবং পথভ্রষ্ট নেতার নেতৃত্বের কারণে আমরা এখন নিজের দেশে পরাধীন। আমাদের নেতা আছে তবে নেই নেতৃত্ব। তার পরও ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা রক্ষার মাস, ফেব্রুয়ারি মাস শহিদের রক্তে রঞ্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি! এতসব কিছুর পরেও, দূরপরবাসে, হৃদয়ে বাংলাদেশ আজও ভাসে। আমি দেশে ছেড়েছি দেশ স্বাধীন করে, দেশকে সোনার বাংলা করব সেই স্বপ্নে কিন্তু পেরেছি কি? তবে চেষ্টা করে চলছি। কী কারণে সত্যজিৎ রায়ের পরিবার দেশ ছেড়েছিলেন সেটা হয়তো কারো অজানা নয়। একই ভাষা, একই আশা, একই মায়ের ভালোবাসা তা সত্ত্বেও যদি ধর্মের কারণেই বিচ্ছেদ তাহলে কেন সেই ধর্মটাও সঠিকভাবে আমরা পালন করছি না, এটাই আমার আফসোস! এই আফসোস কথাটাও বিদেশি শব্দ। খেয়ে পরে বেঁচে আছি বিদেশে, বিদেশি অর্থে।

বিদেশে পরের ভাষায় কথা বলি। বিয়ে করেছি যাকে তিনিও বিদেশি, কেমন করে বিদেশিদের ঘৃণা করি? যাই হোক না কেনো ১৯৭২ সালে সত্যজিৎ রায় ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি একটি ভাষণও দিয়েছিলেন বাংলা ভাষা ও বাঙালির বাংলাদেশের ওপর। তার হৃদয়ের কথা আমার প্রাণে বাজে আজও। কথাগুলো হুবহু তুলে ধরলাম যদি মনে লাগে যেমনটি আমার লেগেছে। ‘বহুদিন থেকে শহীদ দিবসের কথা শুনে আসছি। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না আপনারা বাংলা ভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন। বাংলা ভাষা যখন বিপন্ন, তাকে বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম হয়েছিল, তাতে যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেছেন তাঁদের যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন আপনারা, তাঁদের স্মৃতিকে, সেটা আমি আজকে এখানে এসে বুঝতে পারছি। আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে থাকি, আমরাও বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। এটা ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির মধ্যে আরও পাঁচ রকম সংস্কৃতির প্রভাব এসে পড়ে সেটাকে একটা পাঁচমিশালি ভাব এনে দিয়েছে। ইংরেজির প্রভাব আমরা এখনো পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তার একটা কারণ এই বোধ হয় যে, পশ্চিমবঙ্গ হলো ভারতবর্ষের একটা প্রাদেশিক অংশ মাত্র। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি না। বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা থিয়েটার এসবই পশ্চিমবঙ্গে এখনো বেঁচে আছে, টিকে আছে।

হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল, আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেল এবং আজ শহীদ দিবসে এসে, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা অংশে সফল হলো। এবার আমি অনেক জরুরি কাজ রেখে চলে এসেছি। এবার আর বেশি দিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না; কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে, আমার আশা আছে, অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এ দেশে ফিরে আসব। এ দেশটাকে ভালো করে দেখব। এ দেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব। এ আশা আমার আছে। আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না। সংগীতের অনুষ্ঠান রয়েছে, আপনারা যে আমার কাজের সঙ্গে পরিচিত বা আমার কাজ সম্পর্কে যে আপনাদের কৌতূহল আছে, সে খবর আমি এর আগেই পেয়েছি। কয়েক বছর আগে যখন মহানগর ছবি এখানে দেখানো হয়েছিল, তাতে এখানকার জনসাধারণ কী ধরনের আগ্রহ, কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন এবং তার ফলে কী ঘটনার উদ্ভব হয়েছিল, সে খবর আমার কানে যখন প্রথম পৌঁছায়, আমি সে কথা বিশ্বাস করিনি কিন্তু তারপর এখান থেকে বহু পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে খবরের কাগজের খবর কেটে পাঠিয়েছিলেন। ছবি কেটে পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন সে ঘটনার কথা। তখন বিশ্বাস হয়েছিল এবং বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবতে পারিনি যে এটা হতে পারে। একজন শিল্পী হিসেবে এর চেয়ে বড় সম্মান, এর থেকে গর্বের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। গত ২০ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানাভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহীদ দিবসের পুণ্য তিথিতে আমি বলতে পারি যে আজকের যে সম্মান, সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনো পাইনি আর আমার মনে হয় না, আমি আর কখনো পাব। জয় বাংলা।’

আমি সেই ছোটবেলা থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই স্কুলে- ‘সালাম সালাম হাজার সালাম শহীদ ভাইয়ের স্মরণে। আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে’ গানটি গেয়েছি। হৃদয়ে গেঁথে আছে দিনটি, গানটি, সময়টি, ভাষাটি এবং প্রাণপ্রিয় দেশটি— তাইতো বুক ভরা আশা নিয়ে বার বার ফিরে আসি শহীদ ভাইদের স্মরণে।

লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

/মামুন