০২-এপ্রিল-২০২৫
০২-এপ্রিল-২০২৫
Logo
কলাম

দুর্নীতি কমানো হোক নতুন সরকারের প্রধান কাজ

ড. শফিকুল ইসলাম
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০৩-০৩ ১৬:৫৮:৩৬
...

সম্প্রতি বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। যদিও ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। অর্থাৎ ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩-এ দুর্নীতি বেড়েছে। যা খুবই দুঃখজনক।

এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, দুর্নীতি দারিদ্র্য হ্রাস ও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাধা। বাংলাদেশে দুর্নীতির আশপাশ বিষয়গুলো দৈনন্দিন আলোচনা এবং সাধারণ মানুষের উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু। দুর্নীতি নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় নীতি ও কৌশলগত কাগজপত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় কম। দুর্নীতির কার্যকর প্রতিরোধের জন্য একটি কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয় কথায়। কিন্তু কাজকর্মে তেমন প্রতিফলন দেখছি না। যদি দেখা যেত তা হলে দুর্নীতি হ্রাস পেত। কিন্তু বাস্তবে দুর্নীতি বেড়েছে। সরকারপ্রধান দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে জোর দেওয়ার পরও কেন দুর্নীতি কমছে না! প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টার কমতিও নেই। তাই কোথায় যেন আমাদের দুর্বলতা রয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা একান্ত জরুরি। কারণ দুর্নীতি আমাদের টেকসই উন্নয়নের বড় অন্তরায়। দুর্নীতির কাছে উন্নয়ন বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে চারবার ক্ষমতায়। ফলে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে অনেক। নিজেদের অর্থায়নে আমাদের স্বপ্নের সেতু পদ্মা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। এটি বর্তমান সরকারের বড় অর্জন যা নিয়ে আমরা গর্বিত। কিন্তু দুর্নীতির কারণে সব অর্জন মানুষের কাছে ম্লান হয়ে যায়। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থপাচার বন্ধে তেমন কার্যকর উদ্যোগ দেখছি না। বিদেশে অর্থপাচার ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জন করতে পারতাম। অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের জন্য বারবার দেশ পিছিয়ে পড়ছে। তারা জনগণের টাকা বিদেশে পাচার করে সেকেন্ডহোম বানাচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির রিপোর্ট অনুযায়ী স্বাধীনতার পরের অর্থবছর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে। বর্তমান সরকার যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে, তখন সুইস ব্যাংককে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৫২ কোটি টাকা। ওই তুলনায় শত শত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এই কয়েক বছরে।

অর্থাৎ সরকার টাকা পাচার বা বিদেশের ব্যাংকে টাকা জমা রাখা বন্ধে তেমন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে এত টাকা পাচার হতো না। আর অর্থপাচার বা দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে দেশ অনেক আগেই সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে রূপান্তর হতো। আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা দুর্নীতির রোষানলে পড়ে সব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছি না। কেন আসলে দুর্নীতির কালো বিড়াল বের করছি না! কালো বিড়াল ধরতে গেলে রাঘববোয়াল বের হয়ে আসবেÑ এই ভয়ে কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে না? দেশে আর্থিক সংকট চলছে। আমরা অনেকেই করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে থাকি। এসব কারণ আজকের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে দায়ী নয়। আমরা অনেকেই মনে করি, দুর্নীতি আজকের সংকটের জন্য প্রধানভাবে দায়ী। দুর্নীতি না থাকলে আজকে দেশ এত অর্থনৈতিক সংকটে পড়ত না। দেশের অধিকাংশ মানুষও সেটিই মনে করে। অনেককেই দুর্নীতি করেও বিচারের সম্মুখীন হতে হয় না। দুর্নীতি করে যদি মানুষ সমাজে সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে, তা হলে তো লোকজন দুর্নীতিতে জড়িত হবে এটিই স্বাভাবিক। জাতীয় ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি হতে পারে। রাজনীতি, প্রশাসন ও বেসরকারি খাতে সম্পৃক্ততার সঙ্গে নীতি পর্যায়ের প্রভাবশালীদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মোটা অঙ্কের অর্থের অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়। কারা এই প্রভাবশালী? তাদের কি দুর্নীতি দমন কমিশন খুঁজে পায় না! অর্থপাচার বন্ধ করতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে। এ ছাড়া হুন্ডি বন্ধ করতে হবে এবং আমদানিতে কেউ যেন ওভার ইনভয়েসিং করতে না পারে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাণিজ্যে কারসাজি অর্থপাচারের বড় একটি মাধ্যম। অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের কারসাজি ব্যাপকভাবে মনিটরিং করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চোরাচালান বন্ধ করতে হবে কারণ এ মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচার হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর তথ্য অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এ ছাড়া শীর্ষ তিনে থাকা অপর দুটি সংস্থা হলো পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। এই ৩টি খাতে সবচেয়ে বেশি ঘুষও নেওয়া হয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ ও শাস্তি নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ এসব ব্যক্তির পরিচয় এবং সামাজিক মর্যাদা উপেক্ষা করে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের জীবন ও জীবিকাকে গুরুত্ব দিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতি কমাতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা। একই সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ ও প্রকাশে মিডিয়ার ভূমিকা নিরবচ্ছিন্ন হওয়া জরুরি। সেবা খাতে দুর্নীতি দমনে সর্বস্তরে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও এর যথাযথ প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাকে অবশ্যই তাদের পরিষেবা পদ্ধতির সংস্কার করতে হবেÑ যাতে অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, বিলম্ব ও দ্রুত পরিষেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়। দুর্নীতি প্রতিরোধে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রণোদনা প্রদানের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেবা খাতে দুর্নীতি দমনে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পাশাপাশি দুদককে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

 

/মামুন