০২-এপ্রিল-২০২৫
০২-এপ্রিল-২০২৫
Logo
কলাম

বিদায় অমর একুশে বইমেলা

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০৩-০১ ১৯:৪৫:২৮
...

বাঙালি জাতির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলার শেষদিন আজ শনিবার (০২ মার্চ ২০২৪)। আজ থেকে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বইয়ের পসরা সাজিয়ে আর বসা হবে না দোকানিদের। বইপ্রেমী মানুষ আর দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হবে না মেলা প্রাঙ্গণ। প্রাণের এ বই মেলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও একটি বছর।

এ এক সুখের অনুভূতিও বটে। এই অপেক্ষার গল্পটি পাঠকের মনে জাগাবে এক সুখের অনুভূতি। বন্ধু কিংবা প্রিয়জনদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আড্ডা আর বই কেনার মুহুর্মুহু প্রতিযোগিতার গল্পগুলো চির রঙিন হয়ে জেগে থাকবে মানুষের হৃদয়ে। আর শেষ সময়ে জমে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ। বিক্রিও হচ্ছে দেদারছে। বইমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী ক্রেতাদের ভিড়। তবে ক্রেতার থেকে দর্শনার্থীদের সংখ্যাই মেলায় বেশি।আর সময় যতই ফুরিয়ে আসছে, ততই ভিড় বাড়ছে একুশের বইমেলায়। প্রতিনিয়ত আসছে নতুন নতুন বই। বাড়ছে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের আনাগোনাও। প্রথমদিকের তুলনায় শেষ বেলায় বইমেলা জমে ওঠার চিত্র গেল কয়েক বছরের মতো এবারও দৃশ্যমান। প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা বলছেন, মেলা শেষের দিকে আসায় ক্রমান্বয়ে বিক্রি বাড়ছে, আরও বাড়বে।

এই মানব জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো বই। বই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ‘বন্ধু’ শব্দটি কতই মধুর! বন্ধুত্ব নৈকট্যের পরিচয়বাহী, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও হৃদ্যতা এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও মানসিক বন্ধনের প্রতীক। বন্ধুত্বের ফাটল বেদনাদায়ক হলেও অস্বাভাবিক নয়; যখন তখন লক্ষণীয়। অনেকে আজ বন্ধু কাল শত্রু। বন্ধু হয়ে বেঈমানি আর বিশ্বাসঘাতকতা কারো কাম্য নয়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হলেও অহরহ ঘটছে। শুধু বন্ধু কেন পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে বাবা-মা, ভাইবোন, নিকট আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দূরত্ব। ছড়িয়ে পড়ছে হিংসা হানাহানি। পিপীলিকা যেমন বিপদে পানিতে পতিত গাছের পাতাকে বাঁচার অবলম্বন করে নেয়, তেমনি মানুষও বিপদ হতে বাঁচতে চায়, একটু আশ্রয় খোঁজে। প্রয়োজন হয় ভালো বন্ধুর। রক্ত মাংসে গড়া মানুষকে যেখানে বন্ধু হিসেবে ভেবেও সন্দেহ হয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল কাজ করে, সেখানে মানুষের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে বই। বই বিশ্বাসের অঙ্গ, জীবন যুদ্ধের হাতিয়ার। বই আমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে এনে আলোর দিকে নিয়ে আসে। বই অন্ধকার দূর করে সভ্যতার অগ্রগতি ঘটায়। তাই বই যেমন সভ্যতার রক্ষাকবচ তেমন সভ্যতার চাবিকাঠি। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে বই অতীত ও বর্তমানের বহুমুখী জ্ঞান সম্পদকে বহন করে চলেছে।

দেহের খাদ্য ভাত, রুটি- মনের খাদ্যের যোগান দেয় বই। মনের সুস্থতার ওপর অনেকাংশে দেহের সুস্থতা নির্ভর করে। মনকে সুস্থ রাখতে হলে ভালো বই পড়া দরকার। ভালো বই পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে চেতনা জাগে। তাছাড়া আমরা দেখি যে মানুষেরা বইকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের অনেক শত্রু কম। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের মন ভালো থাকে আমাদের মন প্রসন্নতায় ভরে যায়। তাই বই জ্ঞানের প্রতীক বই আনন্দের প্রতীক।
মানুষ জীবনে তিনটি জিনিস কামনা করে পুরুষ, স্ত্রী এবং বই। অবশ্য এই সহচর নির্বাচনে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। বইয়ের ক্ষেত্রে যার বই পড়তে ভালো লাগে তাকে সেই বই পড়তে দেওয়া উচিত। তাহলে তার কাছ থেকে নতুন চিন্তার ফসল পাওয়া সম্ভব হবে।

জীবনকে বুঝতে হলে অভ্যাসের সংস্কারের বেড়া ভাঙতে হলে বইয়ের সঙ্গ আমাদের অবশ্য প্রয়োজন। আর বইমেলা। শব্দটাকে আলাদা করলে দুটি শব্দ পাওয়া যাবে। একটা বই, অন্যটা মেলা। বই মানেই একটা ভিন্ন জগৎ, ভিন্ন পরিধি। যেখানে প্রবেশ করলে খুব সহজেই ভুলে যাওয়া যায় বাস্তব পৃথিবীকেও। বই শুধু বই-ই নয়, বই একজন ভালো বন্ধুও বটে। যাইহোক বই সম্পর্কে ভালো ভালো সংজ্ঞা আমরা শুনে আসছি। বই নিয়ে তাই আর বিশেষণ দিতে চাই না।

এই যেমন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়। আবার ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, মানুষের জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই। এই যে এতো সুন্দর সুন্দর উক্তি। এরপরও বই সম্পর্কে আমি আর কি বলব!

পরিশেষে বলতে চাই, বইমেলায় প্রতি বছরই বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়ছে! বইয়ের সংখ্যা নয়, মান দেখা জরুরি, উৎকর্ষহীন সংখ্যাধিক্য কারো কাম্য হতে পারে না, এককে এক দিয়ে শতসহস্রবার গুণ করলেও ফলাফল একই থেকে যায়। এত বই বেরুচ্ছে প্রতি বছর, মানসম্পন্ন বই কটি? প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দিয়ে মেলায় স্টল পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়, এখানে বইয়ের মান অবশ্যই দেখা উচিত। বইমেলা শেষে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা নিজেদের লেখক নিয়ে সেরা বইয়ের তালিকা প্রকাশ করে, খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো একটি বই একাধিক পত্রিকার নির্বাচনে সাধারণ রয়েছে, এতেই বোঝা যায় তাদের নির্বাচনের মাপকাঠি কী! এতে পাঠক ও লেখকের কোনো উপকার হয় কি না জানি না। নিরপেক্ষ ও সৃষ্টিশীল লেখকদের একটা প্রকাশ্য কমিটি করে পাঠকদের জন্য কয়েক শো বইয়ের একটা তালিকা প্রস্তুত করে দিতে পারে বাংলা একাডেমী, যেনো পাঠক ভালো বইটি বেছে নিতে পারেন। একটি শর্টলিস্ট প্রকাশ করতে পারে, যেখান থেকে পরের বছর সেরা বইটিকে পুরস্কৃত করা হবে, এক বছর আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ থাকায় শর্টলিস্ট থেকে কোনো ভালো বই বাদ গেলে কিংবা কোনো অযোগ্য বই শর্টলিস্টেড হলে পাঠক তা জানতে পারবেন, এবং পরের বছর এটি শর্টলিস্টেড হতে পারবে। পুরস্কার দেওয়ার জন্য বইয়ের প্রকাশকাল কোনো বিষয় নয়, ‘দ্য টিন ড্রাম’ প্রকাশের চল্লিশ বছর পর এটার জন্য নোবেল পেয়েছিলেন গুন্টার গ্রাস!

লেখক ও প্রকাশকদের চুক্তি বিষয়ে সম্প্রতি কিছু আলোচনা ল করা গেছে, এটা একটা শুভ প্রচেষ্টা। চুক্তি থাকাটা জরুরি, কিন্তু চুক্তিটাই সব নয়, অন্তত বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে এটার সামান্য মূল্যই দেওয়া হয়। অগ্রসর দেশে ‘স্ট্যাটিউটরি রাইটস’ বলে একটা কথা আছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র একটা আইন পাস করতে পারে, যাতে লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে লিখিত কোনো চুক্তি থাকুক বা না থাকুক, একটা বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, ন্যূনতম কিছু দায় ও অধিকার লেখক ও প্রকাশক উভয়েরই থাকবে। স্ট্যাটিউটরি রাইটস-এর আওতায় রতি অধিকারের মতো এখানেও লেখক ও প্রকাশকের অধিকার সংরতি থাকবে। সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনেক হয় বাংলাদেশে, লেখক ও প্রকাশদের সঙ্গে নিয়ে প্রোফেশনাল কিছু হতে দেখা যায় না, এসব বিষয়ে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্তে আসার জন্য বাংলা একাডেমী উদ্যোগী হতে পারে।

অসংলগ্ন ও বিপ্তিভাবে কিছু কথা বলা হলো, এসব নতুন নয়, অনেকেই অনেকভাবে বলেছেন, কিন্তু এসবের প্রতি সামান্য আগ্রহও দেখানো হয় না, আজ হোক, কাল হোক, কাজগুলো আমাদের করতে হবে, দেরি না করাই সঙ্গত মনে হয়। বাংলা একাডেমী থেকে যেমন রুচিশীল ভালো বই বেরুতে পারে, উন্নত মানের গবেষণা হতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের আদর্শ সৃষ্টি করা যেতে পারে, তেমনি সুস্থ ও চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করে জাতির মানস গঠনে একটা ভালো ভূমিকাও রাখা যেতে পারে, রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এটুকু আশা মনে হয় না খুব বেশি কিছু!আর শুরুতে হালকা মেজাজে থাকা বাঙ্গালির প্রাণের এই মেলা বিদায় ক্ষণে পেয়েছে তার পূর্ণতা। তালিকা ধরে এখন বই কিনছেন পাঠকরা। অপরদিকে মেলার সময় দুইদিন বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকাশকদের মুখেও ফুটেছে হাসির ঝলক। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন এমন হাসি বিস্তৃত হোক আগামী মেলাতেও। আবারও প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠুক বাঙালির প্রাণের এই মেলা।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক

/মামুন