০২-এপ্রিল-২০২৫
০২-এপ্রিল-২০২৫
Logo
কলাম

শেষ হলো বাঙালির উৎসব

মুুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০৩-০১ ১৯:৫৫:৫৬
...

শেষ হয়ে গেল বাঙালির প্রিয় মাস ফেব্রুয়ারি। আজ শেষ হচ্ছে বইমেলা। মাসজুড়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানিয়েছে বাঙালি জাতি। ফেব্রুয়ারি ছিল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঔপনিবেশিকের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধের প্রতীক। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে রয়েছে বাঙালির দীর্ঘকালের সংগ্রামের ইতিহাস। ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে এর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিশে^ একমাত্র বাঙালি জাতিই নিজেদের ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার মতো সাহস দেখিয়েছে। অথচ সারা বিশে^ বহু ভাষা নিষ্পেষিত হওয়ার পর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষ তার মুখের ভাষা হারিয়ে কষ্টে ভুগেছে। অথচ বাঙালির বীরত্ব তার ভাষাকে বসিয়েছে এক সম্মানজনক স্থানে। আর এই বিরল আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সারা বিশে^ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে উদযাপনের স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো। বাঙালির সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই। বাঙালি যে একটি ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে এটাই তাদের জন্য কম গৌরবের নয়। সেই একটি ভাষায় তারা সকাল, সন্ধ্যে, রাত অবধি অসনর্গল কথা বলে, স্বপ্ন দেখে। এই মানুষগুলো সংখ্যায় আজ সতেরো কোটি।

বায়ান্নতে জ¦লে ওঠা আগুন এক সময় ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী থেকে ছোট-বড় শহরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে। জাতি এগোতে থাকে মুক্ত, স্বাধীন এক দেশের অভ্যুদয়ের পথে। একুশের অর্জনের ধরাবাহিকতায় একাত্তরে আপামর বাঙালির নিরন্তর ত্যাগ ও তিতিক্ষা, ত্রিশ লাখ শহীদ ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা, পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৫২ খেকে ১৯৭১- এই দুই দশকের আত্মত্যাগ ও আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসকে বারবার স্মরণ করে বাংলাদেশের বাঙালিরা বাংলাভাষার মাহাত্ম্যকে তুলে ধরে বিশ^ দরবারে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নাম। এরপর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে ভাষা শহীদ দিবসের মর্যাদা। বেগবান হয় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি হয় বিশ্বনন্দিত। ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষা আজ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভের পর থেকে একুশের বইমেলাও এক নতুন ধারায় প্রবেশ করতে থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং অমর একুশের বইমেলা একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করিয়ে দেয় না, ফেব্রুয়ারির সঙ্গে বইমেলা শব্দটিও যুক্ত হয়ে যায়। মহান ভাষা আন্দোলনের স্বাক্ষর হিসাবে প্রতি বছর গোটা ফেব্রুয়ারি ধরে চলে একুশের বইমেলা। শুধু ঢাকায়ই নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের যেকোনো সুবিধাজনক সময়ে সারা দেশেই ছোট ছোট বইমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। লেখক, প্রকাশকরাও একুশের মেলায় তাদের শ্রেষ্ঠ বইটি উপহার দিতে নিরন্তর কাজ করে যান। এক সময় বইমেলাতে বিদেশি দূতাবাসগুলো তাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনীর কিছু কিছু বই প্রদর্শনের জন্য স্টল দিতো। কিন্তু এখন আর তা দেখা যায় না। একুশের বইমেলা যেহেতু শুধু বাংলা বই প্রকাশের মেলা, তাই প্রকাশকরা বিদেশি প্রকাশনার অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। একুশের বইমেলায় বিভিন্ন স্টলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অংশের প্রবীণ, নবীন লেখকের নানা ধরনের বইয়ের পসরা বসে। মেলায় সমবেত হন বাংলাদেশের বাংলাপ্রেমী লেখক, পাঠক। কখনো দেখা মেলে পশ্চিমবঙ্গসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আগত কিছু অতিথির। একুশের গ্রন্থমেলার মধ্য দিয়ে লেখক-পাঠক মত বিনিময়, ভাবের আদান প্রদানের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। তারপরও বলতে হয় স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আমরা বায়ান্ন’র আত্মত্যাগের অভিযাত্রার কাক্সিক্ষত লক্ষে পৌঁছুতে পারিনি। বরং ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি। পোশাক পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে আমাদের অর্জিত গৌরবও অনেকটা হারিয়ে যেতে চলেছে। সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি অফিস, আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে। দেশে প্রকাশিত, মুদ্রিত বাংলা বইয়ে অসংখ্য ভুল ভ্রান্তি এবং অসঙ্গতি চোখে পড়ে। বাংলা বানানেও আজ অবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি একটি জাতীয় মান। তারপরও ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করার নানা আয়োজন, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলা থেকে বয়সনিবির্শেষে হাজার হাজার মানুষের অগণিত বাংলা বই কেনা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়া বাংলার ঐশ্বর্যের মূল্য অনেক।

একটু একটু করে অমর একুশের বইমেলার পরিধি সম্প্রসারিত হয়ে বাংলা একাডেমির চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অবধি বিস্তৃত হয়েছে বেশ ক’বছর হলো। মেলার পরিসরের সাথে বেড়েছে স্টলের সংখ্যা। বাড়ছে ক্রমশ প্রকাশিত বই।

গেল তিন বছর বিশ^ব্যাপি করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। তিন বছর করোনার কারণে একুশে বইমেলা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঠক সমাগম, বই বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন পুস্তক প্রকাশকরা। এবারে সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে ১ ফেব্রয়ারি থেকে শুরু হয়েছে বইমেলা। একুশ মূলত বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের তারিখ। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসে দীর্ঘ সময় ধরে মেলায় বইয়ের কেনা-বেচা চলে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা তাদের প্রকাশিত বইয়ের পসরা সাজান। বিদেশি বইয়ের প্রকাশনা মেলায় বন্ধ থাকায় শুধু বাংলা বই প্রকাশ এবং বিক্রয়ের এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় এই বইমেলা। এতে প্রকাশকদের পাশাপাশি বাংলার স্বার্থও সংরক্ষিত হয়। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার বিশেষ সুযোগ ঘটে। সারা বছর ধরে বাংলা ভাষা সাহিত্যের যে বই বিক্রি না হয় শুধু একুশে বইমেলায় তারচেয়ে অনেক বেশি বই বিক্রি হতে দেখা যায়।

বাংলা ভাষা-সাহিত্যে দেশে অনেক বিশ্বমানের লেখক থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাহিত্য এখনও বিশ্বে তেমন সুপরিচিত নয়। তাই বাংলা ভাষার সাহিত্যকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণাসহ বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলায় লিখিত ভালো বইগুলোকে বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের উপর জোর দিতে হবে। তেমনি বিদেশী বিভিন্ন উন্নত মানের বইকে বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নিতে হবে। অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসব। বাংলাদেশের বৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। এ উৎসবে সকল অশুভশক্তির দূর হোক। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক দীনতা যেন উৎসবের ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে দিতে না পারে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক বাহক এই বইমেলা অতীত গৌরব অক্ষুণ্ন রেখে যেন ইতি টানতে পারে। আলোর দিশারী বইলোকে কেন্দ্র করে বই দেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাক, দূর করে দিক সকল অন্ধকার। দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ায় ব্রতী হোক মানুষ। অমর একুশে বইমেলা সকল অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে মাথা উঁচু করে বাঙালিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে এক অপসাম্প্রদায়িক, উন্নত সাহিত্য-সংস্কৃতিসমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেবেÑ এটাই অমর একুশে বইমেলা থেকে আজকের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গল্পকার

/মামুন