দেশব্যাপী আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যে ইতিবাচক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সমাজের সর্বস্তরের শ্রেণী-পেশার সকল মর্যাদার নাগরিক। জাতীয় সংসদ নির্বাচন-উত্তর সরকারের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নাগরিক মনে দীর্ঘকালের অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণের পথ দেখাচ্ছে। অস্বচ্ছ মননের কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেতিবাচক প্রভাবের বলয় থেকে মুক্ত হতে সাধারণ মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্নের বীজ বপন করতে শুরু করেছে আপন আপন সমাজব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে।
রাজনৈতিক চর্চায় প্রায় প্রতিটি দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণের অনেকেই নিজস্ব পন্থায় তৃণমূল পর্যায়ে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একচেটিয়ে প্রভাব বিস্তার করে এসেছেন। কিছু ব্যতিক্রম আছে, যা সাধুবাদ যোগ্য। সংগঠনের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীদেরকে বঞ্চিত করে স্বজনপ্রীতি কিংবা নিজের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে নিজ দলের কিছু অযোগ্য সদস্যদের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করে যোগ্যতার মাপকাঠি থেকে বিচ্যুত হয়ে তাদেরকে বিভিন্ন সাংগঠনিক পদে নেতা নির্বাচন করার প্রবণতা দেখা যায় বহু সংসদ সদস্যগণের মধ্যেই। এমন কি, কখনো কখনো অন্য দল থেকে ভিন্ন কোনো সুবিধা নিয়ে নিজ দলে বড় বড় সাংগঠনিক পদে দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে কিছু নিয়মকানুন কাগজে-কলমে দেখিয়ে নিজ দলের নেতা বানিয়ে দেওয়ার উদাহরণও পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে। আরেকটি বিশেষ বিষয় লক্ষ্যণীয় যে-তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভাগ্য নির্ধারণে বেশ লম্বা একটা সময় ধরে প্রায় সকল দলই ‘টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ’- অর্থাৎ কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা চাপিয়ে দেয়ার পদ্ধতিই অনুসরণ করতে দেখা যায়। এমনও ঘটনা ঘটছে যে, তৃণমূল পর্যায়ে যাকে কোনো দিন রাজনীতি করতেই দেখা যায়নি, কিংবা অসময়ে দলের জন্য যে কোনোই ভূমিকা রাখেনি কোনো দিন, সেই ব্যক্তিও তোষামোদী করে কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সিনিয়র নেতাদের পিএস, এপিএস ইত্যাদি পরিচয় ধারণ করে প্রতারণার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতাদের খুশি করে স্থানীয় পর্যায়ে নেতা হয়েছে। ফলে সংগঠনের আদর্শ ধারণ করে কর্মীবান্ধব এবং জনবান্ধব রাজনীতিতে তারা সমাজ সন্তুষ্টিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে।
অন্যদিকে ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে মূল সংগঠন পর্যন্ত নানা পর্যায়ে জীবনবাজি রেখে যারা দল এবং জনগণের পাশে থেকে রাজনীতি করে দলীয় নেতা হওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের অনেকেই ‘বটম টু টপ’ অ্যাপ্রোচের রাজনৈতিক সংস্কৃতি না থাকার কারণে রীতিমতো হতাশ হয়ে রাজনীতি থেকে অবসর, স্বেচ্ছায় নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কিংবা সরে দাঁড়াবার প্রয়াস কে বেছে নিতে দেখা যায়। নেতা হবার সৌভাগ্যযোগ না থাকলেও দল এবং আদর্শিক রাজনীতির স্বার্থে এদের বেশির ভাগই জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। বড় দলগুলোতে এমনিতেই সভাপতি, সেক্রেটারী এমনকি সাংগঠনিক সেক্রেটারী কেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপ বা রাজনৈতিক উপদলে বিভিন্ন বিভাজন রয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তারা উপজেলা পর্যায়ে প্রত্যেকেই জনপ্রতিনিধি হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসতে চায়। এ চাওয়াটা খুব ন্যায়সংগত এবং স্বাভাবিক। তদুপরি, ওই সকল এলাকাভিত্তিক অনেক সংসদ সদস্যই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে দলীয় সাংগঠনিক কমিটিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের করায়াত্বে জিম্মি করে রাখতেই অভ্যস্ত। ফলে তার মনোনীত প্রার্থী সকল বিবেচনায় অযোগ্য হলেও যোগ্যতম প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অযোগ্য প্রার্থীর পক্ষে জনসাধারণের কাছে ভোট চাইতে বাধ্য হয়। কিছু ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সকল যোগ্যতর প্রার্থীরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে চান না, কেননা দলীয় নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আসতে হয়।
চলমান এমন একটি প্রক্রিয়ায় সমাজের মানুষের চারিত্রিক দৃঢতা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। গল্প আছে- একবার একজন প্রার্থী এক ভোটারকে আহবান করছিলেন এই বলে যে- ‘চাচা আসুন এক কাপ চা খাই।’ প্রতি উত্তরে চাচা বললেন- ‘চা খেয়ে আর কী হবে? গত বছর তিন হাজার টাকা দিয়ে ভোট কিনেছিলে, এবার ৫ হাজার টাকা দিয়ে যাও।’ কৌতূহলে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘চাচা এবার ২০০০ টাকা বেশি কেন?’ চাচা উত্তর দিলেন- ‘আমি অপরাধ না করেও তোমার এক বিচারে ৫০০০ টাকা জরিমানা দিয়েছি, তোমার তা ভুলে যাবার কথা নয়। এমনকি জরিমানা দিয়েও অপমানের হাত থেকে রেহাই পাইনি তোমাদের বিচারে। প্রাণনাশের আশঙ্কা থেকে অপমানের মূল্য টুকু আর চাইলাম না।’
এরকম হাজারো অভিজ্ঞতা নিয়ে বসবাস করছে সমাজের মানুষ আর দিন যত গড়াচ্ছে- ততটাই রাজনীতির প্রতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের প্রতি অনীহা বাড়ছে সাধারণ মানুষের। সংখ্যা বিচারে খুব কম, তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে, যাদের সংখ্যা সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় অনেক অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন।
চলমান সমাজই তার হৃত সামাজিক মর্যাদার সৌরভ ছড়াতে পারে আবার, যদি......!
লেখক : পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
/মামুন
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL