অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনায় জনমনে একধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। রাজধানীর সাম্প্রতিক আগুনের লেলিহান শিখা যেন ফুলকি ছড়িয়েছে দেশে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ (বৃহস্পতিবার) রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুন লাগা ভবনটির প্রতিটি তলার সিঁড়ি ছিল বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডারে ঠাঁসা; যা ব্যবহৃত হতো রেস্টুরেন্টে রান্নার কাজে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাখা সেসব গ্যাস সিলিন্ডারই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো ঘটনায়।
আগুনের সূত্রপাত কিংবা ক্ষয়ক্ষতির পুরোপুরি তথ্য কোনো সংস্থা এখনো না দিতে পারলেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ভবনটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল কি-না এ বিষয়ে। যদিও সিআইডি বলছে, কেমিক্যাল পরীক্ষা করে উদঘাটন করা হবে দুর্ঘটনার পেছনের কারণ। এই বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন সময় ঘটেছে আরও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এসব ঘটনায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। সাক্ষী হয়ে আছে আগুনের ভয়াবহতার। বাংলাদেশে অগ্নিঝুঁকি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। যেখানে প্রতি বছরই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি হ্রাস পাওয়ার কথা, সেখানে পরিসংখ্যান দিচ্ছে উল্টো তথ্য। যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা আর অগ্নিকাণ্ডে বসবাসের অযোগ্য শহর ঢাকা। এর মধ্যে অগ্নিকাণ্ড মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
বসুন্ধরা সিটি: ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বসুন্ধরা সিটিতে লাগা আগুনে মারা যান সাতজন। একই জায়গায় ২০১৬ সালে আবারও ঘটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ঘটনাটি পুরো ঢাকা শহরকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তীব্রভাবে।
নিমতলী ট্র্যাজেডি: ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে বিস্ফোরণ থেকে আগুনের ঘটনায় নারী এবং শিশুসহ নিহত হয় ১২৪ জন। আহত হয় অর্ধশতাধিক। নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত ৯টায় ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় দুই বোন রুনা আর রত্মা এবং পাশের বাড়িতে আসমা নামে এক মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। কনেরা পার্লারে সাজছিল। আর বাড়ির নিচতলায় রান্না চলছিল। রান্নার জায়গার পাশেই ছিল কেমিক্যালের গুদাম। প্রচণ্ড তাপে গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিক ড্রাম গলে যায়। এরপর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি: ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। যা ছড়িয়ে পড়ে সড়কে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেটকার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি ও মোটরসাইকেলে। কিছু বুঝে উঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে যেন মৃত্যুকূপ! আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তার আগেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১। এতে আহত হন কয়েক শ মানুষ।
বনানী এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডি: ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৭০ জন। অগ্নিকাণ্ডের পর আগুন যখন দ্রুত অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভবনের ভেতর আটকাপড়া অনেকে ভবনের কাঁচ ভেঙে ও রশি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। এ সময় কয়েকজন নিচে পড়ে মারা যান। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ, বিমান এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৬ ঘণ্টা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
অগ্নিকাণ্ডের জন্য ভবনের অনুমোদন, নকশার ত্রুটি ও অগ্নিনিরাপত্তাকে দায়ী করা হয়। ওই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে সরকার। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনের তালিকা তৈরি করে রাজউক। কথা ছিল, সেই তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। ভেঙে ফেলা হবে সব নকশা বহির্ভূত অবৈধ স্থাপনা।
কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার থেমে যায় সব উদ্যোগ। এখন আর কেউ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে কথা বলেন না। শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা। অভিযানও চালানো হয়নি নকশা বহির্ভূত কোনো ভবনের বিরুদ্ধে।
মগবাজারের বিস্ফোরণ: রাজধানীর মগবাজারে ২০২১ সালের ৭ জুন ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচ তলায় বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি। প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা বলেছেন, বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই বিকট ছিল যে, এমন বিকট আওয়াজ তারা আগে শোনেননি।
রাজধানীর বস্তিতে আগুন: ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। এর আগে, ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে বউবাজার বস্তিতে আগুনে পুড়ে যায় ৫০টি ঘর। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর একই বস্তিতে লাগা আগুনে প্রাণ হারান ১১ জন। একই বছর ১২ মার্চ রাজধানীর পল্লবীর ইলিয়াস আলী মোল্লা বস্তিতে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে বস্তির প্রায় ৫ হাজার ঘরের সব পুড়ে যায়। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই বস্তিগুলোতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন: ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
তারা বলেছে, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার। ফায়ার সার্ভিস গঠিত তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণও প্রায় একই রকমের। তারা বলছে, মশার কয়েলের আগুন বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত।
অন্যদিকে ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ২২৬টি দোকান পুড়ে গেছে। মার্কেটের মালিক সমিতি বলছে, আগুনে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শটসার্কিট) থেকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি।
পরিশেষে বলতে চাই, বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ নামের ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এর বেশির ভাগই ব্যবহার হয়েছে রেস্তোরাঁ হিসেবে; যা সুস্পষ্টভাবে ইমারত আইন ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয়। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ, একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। ছিল মোবাইল ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং পোশাক বিক্রির দোকানও। ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। ভবনের মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতা, ভবনে থাকা রেস্তোরাঁয় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে উদাসীনতার কারণেই অগ্নিকাণ্ডে এত প্রাণহানি হয়েছে। অথচ ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার কোনো অনুমতি ছিল না। আর রাজউক কর্তৃক ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে) এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম তলা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। ভবনটিতে রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানি ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার পর মালিকরা পুরো ভবনটি বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করছিলেন, যেখানে অনুমোদনহীনভাবে বেশিরভাগই ছিল রেস্টুরেন্ট। মালিকরা বেশি ভাড়ার জন্য এক কাজের জন্য অনুমতি নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করছিলেন। ভবন মালিকদের অতি মুনাফা লাভের প্রবৃত্তি এই আগুনের ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।আর ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না আর এই দুর্ঘটনার আগে ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ভবন মালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীরা। বিপরীতে বার বার নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার পর উত্তাপ আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভবনটির ওপরের তলাগুলো। চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে যারা মারা গেছেন তাদের অনেকে কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ একটি বদ্ধ ঘরে যখন বের হতে পারে না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালিতে চলে যায়। ভবনে জানালা না থাকা এবং পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন তথা বায়ুপ্রবাহের ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছিল শুধু একটিমাত্র সিঁড়ি। আর ভবনের একটি ফ্লোর ছাড়া সব ফ্লোরে অপরিকল্পিত উপায়ে এবং বিপজ্জনকভাবে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল। শুধু গ্রিন কোজি কটেজ নয় বেইলি রোডের আশপাশের সকল ভবনের প্রায় একই অবস্থা। তাই নগর সংস্থাসমূহের নিয়মিত তদারকি থাকলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা এলে গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা না করলে এবং এই বিষয়ে যেসব ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, উদাসীনতা, দায়িত্বহীন ও অন্যায় আচরণ করেছেন, তাদের যথাযথ আইনের আওতায় না আনলে পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক
/মামুন
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL